শৈশব কেটেছে অন্য আরও আট দশজন সাধারণ ছেলের মত অজপাড়া গাঁয়ে। ছিলও না কোন টিভি কিংবা কম্পিউটার। বিদ্যুৎ থাকলেও মাঝে মাঝে মামা বাড়ির মত বেড়াতে আসতো দিন কিংবা রাতের কোন ফাঁকে। সারাদিন ডাংগুলি, মারবেল আর হাডুডু খেলা নিয়ে মেতে থাকতাম আমরা।দল বেঁধে নদীতে নামতাম গোসলে। নান্নু ভাইয়ের ভোরের ব্যাচে পাড়ার ছেলেদের সাথে কাচারি ঘরে চক আর স্লেটের আঁকাবাঁকা অক্ষর দিয়েই লেখাপড়ার হাতেখড়ি।বাড়ি থেকে ২ কিলো হেঁটে প্রাইমারী স্কুলে যেতাম। গ্রীষ্মের খরা রোদে জাতীয় সংগীতে নীরবতা ভাঙত স্কুলের বারান্দা্য। ছুটির বেলের সাথে দলবেঁধে বাড়ি ফিরার আনান্দটাই ছিল অন্য রকম। ভাঙা দালানের ফুটো দরজা আর জানালা বিহিন টিনের ঘরে ঘর্মাক্ত দেহে প্রাইমারীর গণ্ডি পেরিয়ে টিনের ঘরে ঘর্মাক্ত দেহে প্রাইমারীর গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। বাড়ি থেকে ১০-১২ কিলো দূরে সাইকেলে করে স্কুলে যেতাম। প্যাডেল পা লাগতো না তাই বড় ভাইয়ের সাইকেলের পিছনে কেরিয়ারে জায়গা হলো।
রাগী অঙ্ক স্যারের জোড়া বেতের ভয়ে দৈনিক পড়া তৈরী করতাম হারিকেনের নিবু নিবু আলোই। পড়াশুনার আসুবিধার জন্য বাবা সবাইকে নিয়ে শহরে চলে আসলেন। শুরু হলো ভালো করার মিশন। অষ্টম শ্রেণীতে এ গনিত আর বিজ্ঞানে ভাল ফল করায় নবমে বিজ্ঞান বিভাগ পেলাম। আরও মনোযোগ দিলাম পড়াশুনায়। এসএসসিতে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে এইচএসসিতেও বিজ্ঞান নিলাম। শুরু হলো আসল যুদ্ধ। সকাল ছয়টায় বের হতাম কাক ডাকা ভোরে প্রাইভেট পড়তে হাবিব স্যার এর বাসায় তারপর সোজা কলেজে। কলেজ শেষ করে চলে যেতাম পাবলিক লাইব্রেরীতে বন্ধু আতাউর এর সাথে। দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা হতো। বই পড়া একটা নেশায় পরিণত হল। কবিতা, গল্পের বই, সায়েন্স ফিকশান, ক্রুসেড , মাসুদ রানা নানা ধরনের বই পড়তাম। সাথে পত্রিকার শিক্ষা আর খেলার পাতা মিস যেত না একদিনও। সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে মাঝে মাঝে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের ছবিসহ ফিচার পড়তে অনেক ভাল লাগত।
স্বপ্নে হারিয়ে যেতাম আমিও একদিন নামি দামি কোন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। স্বপ্নপূরণে মরিয়া হয়ে পড়াশুনার গতি আরও বাড়িয়ে দিলাম। এইচএসসিতেও ভাল করলাম। ২০০৫ সালে আমার ৪থ বিষয়ই ছাড়াই জি পি এ ৪.৫ যা ছিল টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ এ সর্বোচচ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পছন্দ মত কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলাম না। স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবো। রুয়েট, এমএসটি, বুটেক্স এ অপেক্ষামান তালিকায় থেকে ডাক পেলাম না। স্বপ্নটা অনেকটা ফিকে হতে লাগল। এভাবে ১ বছর পড়াশুনার বাইরে কেটে গেল। দিন দিন হতাশা বাড়তে লাগলো। পরে মামার হস্তক্ষেপে ভর্তি হলাম একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি) টেক্সটাইল ডিপার্টমেন্টে। আমি দমে যায়নি। সিজিপিএ ধরে রাখলাম ৩.৮১। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাড় ও পেয়ে গেলাম ৪০%। স্বপ্নটা তখনও জ্বলছিল নিবু নিবু। কিন্তু তৈরি হল নতুন সমস্যা মায়ের অসুখ আর আদরের ছোট ভাইয়ের কিডনি সমস্যা দেখা দিল। সংসারের হাল ধরতে স্বপ্ন গুলো পকেটে রেখে চাকুরি নিলাম তুরাগ গার্মেন্টসে। শুরু হল নতুন জীবন। ভালই চলছিল, ১ বছর এর মাথাই সফলতা পেলাম। নিজের চেষ্টায় আরঅ্যান্ডডি সেকশন হল। পদোন্নতি ও পেলাম। হটাত একদিন ঢাকায় ভাল একটা বিদেশী বায়িং হাউজে অফার পেলাম। চকচকে ঝকঝকে দালানে ঘেরা গুলশান লেক এর সাথে আমার অফিস। বেতন ও ভাল। তবু কেন যেন একটা কষ্ট। স্বস্থিও নেই মনে। তারপরও জীবনের তাগিদে নিরন্তর ছুটে চলা। বছরে ২ বার অস্ট্রেলিয়ান টিম এর সাথে কাজ করার সুযোগ হতো। একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স্ক ফেব্রিক টেকনোলজিস্ট হঠাত একদিন আমাকে উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করলেন। বললেন প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন। তার অনুপ্রেরণাই ভর্তি হলাম আইইএলটিএসে। আবেদন শুরু করলাম কোরিয়া এবং চায়নাতে বৃত্তির জন্য।
এরই মধ্যে কোরিয়ার সরকারী স্কলারশীপের জন্য আবেদন করলাম। পেয়েও গেলাম স্বপ্নের সেই টিকিট। সুযোগ পেলাম কোরিয়ার এক নাম্বার বিশ্ববিদ্যালয় সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করার। কোরিয়া সরকার পড়াশুনা যাবতীয় খরচসহ ইনসুরেন্স এবং থাকাখাওয়া বাবদ ৮০০ ডলার দেয়। কোরিয়াতে মাস্টার্স এর পাশাপাশি কোরিয়ান ভাষা কোর্স করছি। ক্লাস শেষে প্রতিদিনই লাইবেরিতে যাই আর প্রতি সন্ধ্যায় মেতে থাকি বিদেশি বন্ধুদের সাথে আড্ডায়। সপ্তাহে ছুটির দিনে ক্রিকেট, ফুটবল খেলি কিংবা ঐতিহ্যবাহী জায়গা ঘুরতে যাই। শুধু নিজের সফলতা না যখন বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি হিসাবে দেশের পতাকা ধরি তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়। আমার এই সফলতার জন্য বাবা,মা, শিক্ষক এবং Royston Barns এর প্রতি আমি সবসময় কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যতে একজন টেক্সটাইল টেকনোলজিস্ট হয়ে দেশের সেবা করতে চাই।
মোঃ আশিকুর রহমান, ডিপার্টমেন্ট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া।