দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে প্রণীত ‘অভিস্বীকৃতি (অ্যাক্রেডিটেশন) কাউন্সিল আইন, ২০১৬’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে আইনটির অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রিসভার গতকালের বৈঠকে অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল আইন ছাড়াও ‘বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৬’ ও ‘আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা ইনস্টিটিউট-বাংলাদেশ আইন, ২০১৬’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদনও দেয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। পাশাপাশি চলতি বছর তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মন্ত্রিসভায় নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার গত বছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল আইনটি চূড়ান্ত হলে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এ কাউন্সিলের অনুমতি নিতে হবে। আইনের ৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, কাউন্সিল গঠন হবে ১৩ সদস্য নিয়ে। এর মধ্যে একজন চেয়ারম্যান থাকবেন। এছাড়া চারজন পূর্ণকালীন ও আটজন খণ্ডকালীন সদস্য থাকবেন।
সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত মিলে দেশে বর্তমানে ১৩২টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এর আওতাধীন একাডেমিক প্রোগ্রামগুলোর অ্যাক্রেডিটেশন প্রদান ও মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সম্প্রতি ‘অভিস্বীকৃতি (অ্যাক্রেডিটেশন) কাউন্সিল আইন, ২০১৬’-এর খসড়া তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। এ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে তাদের স্বীকৃতি ও কনফিডেন্স সনদ প্রদান করবে। দেশের সব সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় এ আইনের আওতায় থাকবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে একটি অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল থাকা দরকার। এ কাউন্সিল গঠনের লক্ষ্যে একটি খসড়া আইন তৈরি করা হয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি, সব বিশ্ববিদ্যালয় এ আইনের আওতায় একই সারিতে থাকবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে শিগগিরই এ আইন চূড়ান্ত করা হবে। তবে এ আইন বাস্তবায়ন হলে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অস্তিত্ব হারাবে।’
আইনের খসড়া অনুযায়ী, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল একাডেমিক প্রোগ্রাম ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বীকৃতি দেবে। অ্যাক্রেডিটেশন সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় তথ্য ও ফি প্রদানের মাধ্যমে কাউন্সিল বরাবর আবেদন করবে। এর পর কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞ সদস্যের একটি অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) কমিটি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করবে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত তথ্যাবলি পর্যবেক্ষণ করে মতামতসহ একটি প্রতিবেদন দেবে কমিটি। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় শর্তসাপেক্ষে কাউন্সিল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কনফিডেন্স ও অ্যাক্রেডিটেশন সনদ দেবে।
কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স ইউনিটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ও মানদণ্ডের আলোকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এর আওতাভুক্ত প্রোগ্রামগুলোর যোগ্যতা নিরূপণ করা হবে। অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের সংবিধিতে বলা হয়েছে, চিকিত্সা, প্রকৌশল, কৃষি, ব্যবসায়, আইন, সমাজবিজ্ঞান, মানবিক, জীববিজ্ঞান ও ভৌত বিজ্ঞানসহ উচ্চশিক্ষার বড় ক্ষেত্রগুলোর জন্য পৃথক অ্যাক্রেডিটেশন কমিটি থাকবে।
এছাড়া অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল আইনে কিছু বিধিনিষেধও আরোপ করা হয়েছে। এগুলো হলো— কাউন্সিল প্রদত্ত সনদ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান নিজ প্রসপেক্টাস বা ব্রশিয়রে অভিস্বীকৃতিপ্রাপ্ত উল্লেখ করতে পারবে না, কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সনদ প্রত্যাহার করার পর ওই প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা সমর্পণে বাধ্য থাকবে এবং পরিদর্শনকালে কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভুল তথ্য উপস্থাপন বা কোনো তথ্য গোপন করতে পারবে না। এছাড়া এ-বিষয়ক বিদ্যমান আইনগুলোর সঙ্গে কোনো কিছু সাংঘর্ষিক হলে নতুন আইনটিই প্রাধান্য পাবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়।
উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে এ আইনকে একটি ভালো উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের মতে, গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও তা বিতরণই উচ্চশিক্ষার মূল দর্শন। কিন্তু দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এ দর্শন থেকে অনেকটাই দূরে। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিভিন্ন মহলে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, দেশে অনেক আইনই লিখিতভাবে থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ থাকে না। আশা করছি, এ আইন যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা খাতের চিত্র বদলাবে। বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো আমাদের শিক্ষার মানও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
এদিকে একই দিনে ‘বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৬’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদনও দেয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা ইনস্টিটিউট- বাংলাদেশ আইন, ২০১৬’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এখানে দুটি আইন প্রণীত হয়েছিল— একটি ১৯৭৮ সালে, আরেকটি ১৯৮৫ সালে। দুটিই সামরিক শাসনামলের। এজন্য দুটো আইনকে বাংলায় রূপান্তর ও একীভূত করে নতুন আইন করা হয়েছে। তবে ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬’-এর খসড়া বৈঠকে উপস্থাপন করা হলেও মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন দেয়নি। এক্ষেত্রে ১৯৬১ সালের মূল আইনটি ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তরের পর সংশোধনী আনার অনুশাসন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
তিনি জানান, মন্ত্রিসভা বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে ২০১৬ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। চলতি বছর তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মন্ত্রিসভায় নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার গত বছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এ বছরের ১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মন্ত্রিসভায় নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার ছিল ৬৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৫৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তৃতীয় ত্রৈমাসিকে আটটি মন্ত্রিসভা বৈঠক হয়েছে। এতে ৫৬টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে ৩৬টি। বাকি ২০টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ১১টি মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় ৭৮টি সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে বাস্তবায়ন হয় ৪৫টি।
গত তিন মাসে মন্ত্রিসভা বৈঠকে চারটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুমোদন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ সময় সংসদে আইন পাস হয়েছে ১০টি। তবে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোয় কোনো নীতি বা কর্মকৌশল অনুমোদন হয়নি। গত বছরের একই সময়ে তিনটি নীতি বা কর্মকৌশল অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রিসভা।বণিক বার্তা।