বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপীই শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও চিত্রটা একই। বছর তিনেক আগে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদেরও পছন্দের শীর্ষে ছিল যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে বর্তমানে এতে পরিবর্তন এসেছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের শীর্ষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে এখন মালয়েশিয়া।
নিকটতম দূরত্ব, পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ ও তুলনামূলক কম খরচে শিক্ষালাভের সুযোগকে উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়াকে বেছে নেয়ার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা। দেশটিতে বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলাকেও এর আরো একটি কারণ বলে জানান তারা। যদিও মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি দেশে নিহত জঙ্গিদের দুজন ছিলেন মালয়েশিয়া মোনাশ ইউনিভার্সিটির ছাত্র।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার গন্তব্য নিয়ে প্রতি বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার শীর্ষ গন্তব্য হিসেবে মালয়েশিয়ার নাম উঠে এসেছে।
‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন বলছে, ২০১৪ সালে মোট ২৪ হাজার ১১২ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। এর মধ্যে ৫ হাজার ২৭১ জন যান মালয়েশিয়ায়। এ হিসাবে ২০১৪ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশগামী শিক্ষার্থীর ২২ শতাংশ গেছেন মালয়েশিয়ায়।
যশোরের এমএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান মনি খান। সেখানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়েছেন তিনি। মালয়েশিয়া যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত চাকরির জন্যই মালয়েশিয়ায় আসা। স্টুডেন্ট ভিসা সহজলভ্য হওয়ায় একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছি। মাঝে মধ্যে ক্লাসে অংশগ্রহণ করলেও অর্থ উপার্জনই মূল লক্ষ্য।
একসময় যুক্তরাজ্যই ছিল উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের শীর্ষ গন্তব্য। ২০১৩ সালেও উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশগামী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর ১৭ শতাংশ যান যুক্তরাজ্যে। ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের শীর্ষ গন্তব্য থাকলেও ২০১৪ সালে নেমে এসেছে দ্বিতীয় স্থানে। ওই বছর ৪ হাজার ৮৬৮ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
জানা যায়, ২০১০-১১ সালের দিকে যুক্তরাজ্যের নামসর্বস্ব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের ভিসা নিতে থাকে। তবে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারায় কয়েক বছর পর এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই বন্ধ করে দেয় যুক্তরাজ্য। এ সময় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হাজার হাজার শিক্ষার্থী সেখানে অবৈধ হয়ে যান। এর পর থেকেই উচ্চশিক্ষায় যুক্তরাজ্য গমনের হার হ্রাস পেতে থাকে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের মালয়েশিয়াকে বেছে নেয়ার কারণ জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, দূরত্বের দিক থেকে নিকটবর্তী আর কম খরচে যাওয়ার সুযোগই শিক্ষার্থীদের মালয়েশিয়ামুখিতার মূল কারণ। তবে দেশটির উচ্চশিক্ষার মান আমাদের দেশের চেয়ে ভালো তেমনটা বলা যাবে না। তার পরও পড়ালেখার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকায় শিক্ষার্থীরা দেশটিতে পাড়ি জমাচ্ছে। বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির প্রতারণারও শিকার হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী।
উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়া গিয়ে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছেন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ। গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী জঙ্গিদের অন্যতম নিবরাস ইসলাম ছিলেন মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। এর পর গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহত তিন জঙ্গির একজন তাওসিফ হোসেন। মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন তিনিও।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির দুজন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জঙ্গি-সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকারের সহযোগিতা নিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে বাংলাদেশ। কেননা বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিপথে পা বাড়াচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত হতে হবে। বিদেশে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের ওপর পরিবারের লোকজনের কোনো তদারকি থাকে না। এ সুযোগটি তারা কাজে লাগাচ্ছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখতে হবে।
উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের শীর্ষ ১০ বিদেশী গন্তব্যের মধ্যে যুক্তরাজ্যের পরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৪ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশটিতে গেছেন ৪ হাজার ৫৬৫ বাংলাদেশী শিক্ষার্থী। ২০১৩ সালে গিয়েছিলেন ৩ হাজার ৬৬৪ জন। চতুর্থ শীর্ষ গন্তব্য অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য ২০১৪ সালে পাড়ি জমান ৩ হাজার ৯১৫ জন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী। এছাড়া কানাডায় যান ১ হাজার ৬১৪, জাপানে ১ হাজার ৫৪, জার্মানিতে ৯৯৩, ভারতে ৭৭৪, সৌদি আরবে ৭৩২ ও ফিনল্যান্ডে ৫৩৫ জন।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর বলেন, অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়েই বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের শীর্ষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে মালয়েশিয়া। আগে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোয় যেত, কারণ সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি উপার্জনের বড় একটি সুযোগ ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এখন সে সুযোগ খুবই সীমিত। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের তুলনায় মালয়েশিয়ায় শিক্ষা ব্যয় অনেক কম। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ায় শাখা খোলায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি মালয়েশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য উন্নত দেশে অভিবাসন নেয়ার সুযোগ বেড়ে যায়। এটিও বড় একটি কারণ হতে পারি।
বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশগামী শিক্ষার্থীর ১৯ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। এর পরই রয়েছে যুক্তরাজ্য। বিদেশগামী শিক্ষার্থীর ১০ শতাংশ যান দেশটিতে। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, জাপান, কানাডা, চীন ও ইতালিতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়তে যান।
অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যান— এ ধরনের দেশের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। ২০১৪ সালে দেশটির ৭ লাখ ১২ হাজার ১৫৭ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। এর পরের অবস্থানে রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। ২০১৪ সালে দেশটির ১ লাখ ৮১ হাজার ৮৭২ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশে যান। এছাড়া জার্মানির ১ লাখ ১৯ হাজার ১২৩, রিপাবলিক অব কোরিয়ার ১ লাখ ১৬ হাজার ৯৪২, ফ্রান্সের ৮৪ হাজার ৫৯, সৌদি আরবের ৭৩ হাজার ৫৪৮, যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ হাজার ২৯২, মালয়েশিয়ার ৫৬ হাজার ২৬০, ভিয়েতনামের ৫৩ হাজার ৫৪৬ ও নাইজেরিয়ার ৫২ হাজার ৬৬ জন শিক্ষার্থী ২০১৪ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। বণিকবার্তা।