যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে প্রার্থী নির্বাচন করেছে দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন কেন্দ্র করে জমে উঠেছে বাকযুদ্ধও। পাশাপাশি চলছে বিভিন্ন জরিপ। সম্প্রতি পিউ রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত, এমনই একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের প্রতি দেশটির নিবন্ধিত ভোটারের সমর্থন বেড়েছে। গত বুধবার সংস্থাটি তাদের এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের প্রতিবেদন মতে, জাতীয় নির্বাচন এখনই অনুষ্ঠিত হলে নিবন্ধিত ভোটারদের ৪১ শতাংশ হিলারিকে বেছে নেবেন। এর বিপরীতে ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন ৩৭ শতাংশ ভোটার। আর গ্যারি জনসন ও জিল স্টেইনের প্রতি সমর্থন রয়েছে যথাক্রমে ১০ ও ৪ শতাংশ ভোটারের।
পিউ রিসার্চ সেন্টার যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থা। মূলত জনমত জরিপ ও জনমিতিভিত্তিক গবেষণা করে থাকে সংস্থাটি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে সংস্থাটি চলতি মাসে একটি জনমত জরিপ করে। এতে দেশটির ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও কলম্বিয়ার ১৮ বা তদূর্ধ্ব বয়সের মোট ২ হাজার ১০ জন ভোটারের মত দৈবচয়নের ভিত্তিতে নেয়া হয়। টেলিফোন ও মোবাইলের মাধ্যমে তাদের এ মত নেয়া হয়। প্রিন্সটন সার্ভে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটস ইন্টারন্যাশনালের আওতাধীন প্রিন্সটন ডাটা সোর্সের সদস্যরা এ সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেন। পরে অংশগ্রহণকারীদের দেয়া বিভিন্ন তথ্যকে ২০১৪ সালে দেশটির সেনসাস ব্যুরো পরিচালিত জাতিগত জরিপ ও জনঘনত্ব-বিষয়ক জরিপের তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। এছাড়া ন্যাশনাল হেলথ ইন্টারভিউ সার্ভের বিভিন্ন তথ্যও এতে সমন্বিত করা হয়।
সংগৃহীত এসব তথ্য পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের পর পিউ রিসার্চ সেন্টার গত বুধবার এ-সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, সার্বিকভাবে আসন্ন নির্বাচনে জনসমর্থনের দিক থেকে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে রয়েছেন। ট্রাম্প ও হিলারির বাইরে অন্য দুই প্রার্থী জনসন ও স্টেইনের সমর্থকদের মধ্যেও একটি অংশ রয়েছে, যারা দ্বিদলীয় নির্বাচন হলে হিলারিকেই বেছে নেবেন বলে জানিয়েছেন।
দুই প্রার্থীর সমর্থকদের জাতিগত ও লৈঙ্গিক পরিচয়ও সন্নিবেশিত হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে এ দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে লৈঙ্গিক বিভাজন বেশ সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। প্রতিবেদন মতে, নারী ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন তুলনামূলক কম। অন্যদিকে পুরুষ ভোটারদের মধ্যে হিলারি কিছুটা অজনপ্রিয়। নারী ভোটারদের ৪৯ শতাংশই সমর্থন জানিয়েছেন হিলারিকে। এর বিপরীতে ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন রয়েছে ৩০ শতাংশ নারী ভোটারের। আর পুরুষ ভোটারদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের সমর্থন রয়েছে হিলারির প্রতি। যেখানে ট্রাম্পের প্রতি তাদের ৪৫ শতাংশেরই সমর্থন রয়েছে।
অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিক বিবেচনায়ও এগিয়ে রয়েছেন হিলারি। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে হিলারি কিছুটা অজনপ্রিয় হলেও কৃষ্ণাঙ্গ সমর্থন তাকে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে। প্রতিবেদন মতে, শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের ৩৩ শতাংশের সমর্থন রয়েছে হিলারির প্রতি আর ট্রাম্পের প্রতি রয়েছে ৪৫ শতাংশের। হিলারি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে। ৮৫ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারেরই সমর্থন রয়েছে তার প্রতি। আর ট্রাম্পের প্রতি মাত্র ২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারের সমর্থন রয়েছে। হিস্পানিক ভোটারদের মধ্যে এ হার যথাক্রমে ৫০ ও ২৬ শতাংশ।
উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেও হিলারির জনপ্রিয়তা লক্ষণীয়। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে, এমন ভোটারদের ৫৯ শতাংশই সমর্থন করেন হিলারিকে। এর বিপরীতে ট্রাম্পের প্রতি এ অংশের ভোটারদের মাত্র ২১ শতাংশের সমর্থন রয়েছে। স্নাতক সম্পন্ন করেছে, এমন ভোটারদের মধ্যে এ হার যথাক্রমে ৪৭ ও ৩৪ শতাংশ। একই অবস্থা তরুণদের ক্ষেত্রেও। ৩০ বছরের কম বয়সী ভোটারদের ৩৮ শতাংশ হিলারি ও ২৭ শতাংশ ট্রাম্পকে সমর্থন করেন। যেসব ভোটারের বয়স ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, তাদের ৪৬ শতাংশ হিলারি ও ২৯ শতাংশ ট্রাম্পকে সমর্থন করেন। আর ৬৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সের ভোটারদের ৪৭ শতাংশই সমর্থন করেন ট্রাম্পকে। এর বিপরীতে এ বয়সী ভোটারদের ৩৯ শতাংশের সমর্থন রয়েছে হিলারির প্রতি।
ভিন্নতা দেখা গেছে ভোটারদের প্রবণতার মধ্যেও। জরিপে অংশগ্রহণকারী ট্রাম্প সমর্থকদের ৮১ শতাংশই মনে করে ৫০ বছরের ব্যবধানে মার্কিন জীবনমান আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। এর ঠিক বিপরীত অবস্থানেই রয়েছেন হিলারি সমর্থকরা। তাদের ৫৯ শতাংশ মনে করে ৫০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। তবে হিলারির সমর্থকদের ১৯ শতাংশ জীবনমানের অবনতি হয়েছে বলেই মনে করে। আর বাকি ১৮ শতাংশ এক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়েছে।
বৈপরীত্য দেখা গেছে জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকেও। ট্রাম্পের অধিকাংশ সমর্থক (৬৮ শতাংশ) হতাশার কথা শুনিয়েছেন। তাদের মতে, আগামী দিনগুলো আরো খারাপ হতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বৈচিত্র্য দেখা গেছে হিলারির সমর্থকদের মতে। তাদের ৩৮ শতাংশ ভবিষ্যত্ নিয়ে আশাবাদী, নৈরাশ্যবাদী ৩০ শতাংশ। অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না বলে মনে করে ২৮ শতাংশ হিলারি সমর্থক।
সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিগত পাঁচটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তুলনায় এ নির্বাচনে ঋণাত্বক ভোটের প্রবণতা বেড়েছে। অর্থাত্ হিলারির প্রতি সমর্থন জানানোদের একটি বড় অংশ আদতে ট্রাম্পবিরোধী। ঠিক একই কথা ট্রাম্প সমর্থকদের একটি বড় অংশের জন্যও সত্য। ট্রাম্প সমর্থকদের ৫৩ শতাংশ জানিয়েছে ট্রাম্প সমর্থনে নয়, বরং হিলারি-বিরোধিতার জন্যই তারা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। অন্যদিকে হিলারির সমর্থকদের মধ্যে এ হার ৪৬ শতাংশ। আট বছর আগের নির্বাচনে বারাক ওবামার সমর্থকদের মধ্যে এমন ভোটার ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জন ম্যাককেইনের সমর্থকদের মধ্যে এমন ভোটার ছিল ৩৫ শতাংশ।
প্রতিবেদন মতে, ট্রাম্পকে ঘিরে আশঙ্কার মাত্রাও বেশি ভোটারদের মধ্যে। অংশগ্রহণকারীদের ৫৫ শতাংশই মনে করে নির্বাচিত হলে ট্রাম্প এমন কোনো ভুল করতে পারেন, যাতে পুরো দেশই বিপদে পড়তে পারে। হিলারির বিষয়ে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ৪৪ শতাংশ ভোটার।
দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা গেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও। অভিবাসন ও সন্ত্রাসবাদকে সবচেয়ে বড় সংকট মনে করে ট্রাম্প সমর্থকদের যথাক্রমে ৬৬ ও ৬৫ শতাংশ। হিলারি সমর্থকদের মধ্যে এ হার যথাক্রমে ১৭ ও ৩৬ শতাংশ। সম্পদের বণ্টন বিষয়েও এ দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মতদ্বৈধতা দেখা গেছে। ধনী-দরিদ্র ব্যবধানকে বড় সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছে ৭০ শতাংশ হিলারি সমর্থক। ট্রাম্প সমর্থকদের মধ্যে এ হার মাত্র ৩১ শতাংশ। মুসলমানদের সমালোচনার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা দেখা গেছে। অংশগ্রহণকারীদের ৬৪ শতাংশই সবকিছুর জন্য মুসলিমদের সমালোচনা করা উচিত নয় বলে মনে করে। হিলারি সমর্থকদের মধ্যে ৮২ শতাংশ, আর ট্রাম্প সমর্থকদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ এ মনোভাব পোষণ করে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বিষয়েও দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। হিলারির ৫৯ শতাংশ সমর্থকই এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যেখানে বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে ৬৮ শতাংশ ট্রাম্প সমর্থক। অনুরূপ মনোভাব দেখা গেছে আলোচিত ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) শীর্ষক বাণিজ্য চুক্তির বিষয়েও।