তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার অন্যতম সেরা সাঁতারু। অধিকাংশ দিনই গোলাগুলির কারণে অনুশীলনে যেতে পারতেন না, কখনো গেলেও দেখেছেন সুইমিং পুলে বোমা! গৃহযুদ্ধে বাড়ি-ঘর ধ্বংস হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেন, বোন সারাহকে নিয়ে দেশ ছাড়বেন। তুরস্ক থেকে ডিঙি নৌকায় চেপে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিক দ্বীপ লেসবোস— তাদের গন্তব্য। নৌকায় ওঠার আধঘণ্টা পর মোটর বিকল হয়ে পড়ে, পানি উঠতে শুরু করে ডিঙিতে। মেরেকেটে ছয় থেকে সাতজন বহনে সক্ষম নৌকাটিতে যাত্রী ছিল ২০ জন— এদের মধ্যে সাঁতার জানতেন শুধু ইউস্রা মারদিনি, তার বোন সারাহ এবং অন্য এক মহিলা। এ তিনজনে মিলে ভূমধ্যসাগরে নেমে ৪ ঘণ্টা ডিঙি টেনে পৌঁছে যান লেসবোস উপকূলে। সেদিন থেকে সাগরকে ভীষণ ঘৃণা করেন ইউস্রা, কিন্তু তাকে সারা দিন কাটাতে হয় পানিতে! অলিম্পিকের ইতিহাসে এবারই প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বিশেষ একটি দল— ‘অলিম্পিক শরণার্থী অ্যাথলিট দল’। ইউস্রা মারদিনি এ দলেরই একজন গর্বিত সদস্য।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অ্যাথলিটদের অলিম্পিকে সুযোগ করে দেয়ার দাবি উঠেছিল চলতি বছরের শুরুতে। ইতিবাচক সাড়া দিয়ে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সভাপতি থমাস বাখ বলেছিলেন, ‘অলিম্পিকে এ দলকে স্বাগত জানিয়ে আমরা বিশ্বের সব শরণার্থীকে আশা জোগাতে চাই। সবাইকে এ বিপর্যয়ের কথা জানাতে চাই।’ স্রেফ দয়া-দাক্ষিণ্যের বদৌলতে দলটা সুযোগ পেয়েছে রিও অলিম্পিকে— এমনটা ভাবলে ভুল করবেন। শরণার্থী হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়া ৪৩ অ্যাথলিট ডাক পেয়েছিলেন প্রাথমিক বাছাইয়ে। অলিম্পিক ট্রায়ালে সেখান থেকে চূড়ান্ত দলে সুযোগ পেয়েছেন ১০ জন— সিরিয়ার ইউস্রা মারদিনি (জার্মানিতে আশ্রিত, ২০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল সাঁতার) ও রামি আনিস (বেলজিয়ামে আশ্রিত, ১০০ মিটার বাটারফ্লাই), কঙ্গোর ইয়োলান্দে মাবিকা (ব্রাজিলে আশ্রিত, জুডো ৭০ কেজি ওজন শ্রেণী) ও পোপোলে মিসেঞ্জা (ব্রাজিলে আশ্রিত, জুডো ৯০ কেজি ওজন শ্রেণী), দক্ষিণ সুদানের অ্যাঞ্জেলিনা লোহালিথ (কেনিয়ায় আশ্রিত, ১৫০০ মিটার দৌড়), রোজ লোকোনিয়েন (কেনিয়ায় আশ্রিত, ৮০০ মিটার দৌড়), জেমস চিনজিয়েক (কেনিয়ায় আশ্রিত, ৪০০ মিটার দৌড়), ইয়েচ বিয়েল (কেনিয়ায় আশ্রিত, ৮০০ মিটার দৌড়) এবং পাওলো লোকোরো (কেনিয়ায় আশ্রিত, ১৫০০ মিটার দৌড়)। দলটির বাকি সদস্য ইথিওপিয়ার ইয়োনাস কিন্দে (লুক্সেমবার্গে আশ্রিত, ম্যারাথন দৌড়)।
অলিম্পিক শুরু হবে আগামী ৫ আগস্ট। এদিন মার্চ-পাস্টে অন্য দেশগুলোর মতো তারাও অংশ নেবেন। স্বাগতিক ব্রাজিলের আগে অলিম্পিক পতাকা হাতে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবেন তারা। দেশহীন বিধায় জাতীয় সংগীতের বদলে অলিম্পিক সংগীত গাইবেন এসব অ্যাথলিট। অলিম্পিক গ্রেট মাইকেল ফেলপস, উসাইন বোল্টরা হবেন তাদের প্রতিবেশী— অর্থাত্ তাদের বাসস্থান হবে অলিম্পিক ভিলেজ। রিও অলিম্পিকের পুরো সময় ধরে এ শরণার্থী দলের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য খরচ বহন করবে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)।
ইয়েচ বিয়েল দেশ ছেড়েছিলেন ২০০৫ সালে। তখন তার বয়স মাত্র ১০ বছর। সৈন্যরা গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার পর টানা তিনদিন অনাহারে ঝোপঝাঁড়ের মধ্যে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয় তার পরিবারকে। কিন্তু এভাবে চলবে কত দিন? বাধ্য হয়েই নির্মম সিদ্ধান্ত নেন বিয়েলের মা নায়াগুনি। মাত্র ১৯ মাইল দূরত্বেই ইথিওপিয়ার সীমান্ত। অনাহারে থাকায় লুকিয়ে এ পথটুকু পাড়ি দিতে সপ্তাহখানেক সময় লেগে যাবে। কিন্তু চার সন্তানকে একসঙ্গে নিয়ে তার পক্ষে ইথিওপিয়ায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যগত সমস্যা আর নিরাপত্তার ব্যাপার তো ছিলই। এ কারণে পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে বিয়েলকে কেনিয়ার উদ্দেশে পাঠান নায়াগুনি। এর পর আর মায়ের সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি বিয়েলের। তার ভাইবোনরা কোথায় কেমন আছে, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে— বিয়েল কিছুই জানেন না!
মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকায় গৃহযুদ্ধের ছোবলে ঘর হারিয়েছে প্রায় ২১ মিলিয়ন মানুষ। এছাড়া আরো ৪৪ মিলিয়ন মানুষকে জোর করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। শরণার্থী এ দলটা অলিম্পিকে এসব ঘর হারানোর মানুষেরই প্রতিনিধি। গোটা বিশ্বকে তাই বিয়েলের বার্তা, ‘এ পৃথিবীর মানুষদের জানাতে চাই, আমাদের এ দলটা লাখো শরণার্থীর প্রতিনিধি। হয়তো এমন কোনো দিন আসবে, যেদিন নিজেকেই নিজের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। কারণ আমাদের কোনো দেশ নেই। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত শরণার্থীরা আমাদের মুখপানে চেয়ে আছে। এ কারণে শুধু স্বর্ণ জেতা নয়, তাদের জন্য কিছু করতে চাই আমরা। প্রমাণ করতে চাই শরণার্থীরা বাকি অ্যাথলিটদের মতোই মানুষ, জানোয়ার নয়।’ স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড, গার্ডিয়ান