দুই সপ্তাহ আগে (গুলশান বোমা হামলার সপ্তাহ খানেক আগে) হঠাৎ এক কোরিয়ান পুলিশের ফোন। পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলো আইএস সম্পর্কে আমি কি ধারণা পোষণ করি। উত্তর দেওয়ার পর আবার প্রশ্ন কোরিয়ার বাংলাদেশীরা কেমন ধারণা পোষণ করে। স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলাম কোরিয়া প্রবাসীরা আইএস এর ধারেকাছেও নেই। কোরিয়ার বাংলাদেশী প্রবাসীরা আইএস সম্পর্কে খুব ভালভাবেই জানে। ইসলামে নিরীহ মানুষ মারা কোনভাবেই জায়েজ না উনাকে সেটা ব্যাখ্যা করলাম। পরবর্তী প্রশ্ন অনেকটাই মেজাজ খারাপ করার মতো। “কোরিয়াতে আইএস হামলা করার সম্ভাবনা আছে কিনা”। আমি বললাম সেটা আইএসের কোন সদস্য কিংবা যারা তাদের ইন্ধনদাতা তারা ভাল বলতে পারবে। জিজ্ঞেস করলাম আমার নাম্বার কোথা থেকে পেয়েছেন এবং আমাকে ফোন করার কারণ। উনি নাম্বার পাওয়ার সোর্স উল্লেখ করলেন এবং জানালেন কোরিয়ান সরকারের সতর্কতার কারণেই কোরিয়াতে মুসলিম দেশগুলোর নাগরিকদেরকে এই সম্পর্কে তথ্য নেওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। আমি আরেকটু পরিস্কার করার জন্য উনাকে বললাম এই দুই/চারশ পথভ্রষ্ট আইএস সন্ত্রাসীদের জন্য সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মুসলমানরা। আইএস বেশিরভাগ বোমা মারছে মুসলমানদের দেশে। অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকে যেভাবে হত্যা করা হচ্ছে সেগুলোও এমনভাবে করছে যার মাশুল ঠিকই মুসলমানদের দিতে হচ্ছে। আমি উনাকে বললাম কোরিয়াতে কিছুই হয়নাই অথচ আপনি আমাকে ফোন করেছেন এবং আরো অনেককেই হয়তো ফোন করে হয়রানি করবেন। সাথে সাথে উনি সরি বলে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রোজার মাসে কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন। কোরিয়ান পুলিশ অনেক ভাল বলে হয়ত অনেক কথা আমি মুখের উপর দিয়ে বলেছি। বাংলাদেশের পুলিশ হইলে হয়ত এইসব কথা বলা যেতনা।
গুলশান হামলার পর প্রথম অফিসে গিয়ে সকালেই মিটিং শুরু হলো বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে। একটা বড় রিপোর্ট লিখতে হলো সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। আটটি ফ্যাক্টরিতে আমাদের কোম্পানীর দুইটা ব্র্যান্ডের কাজ চলছে। গুলশানের ঘটনার ৪/৫ দিন আগে একটা টিম বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এসেছে। তারা গুলশানেই ছিল এবং খাওয়াদাওয়াও ছিল গুলশানের রেস্টুরেন্টগুলোতে। এই মাসের শেষের দিকে আরেকটা টিম যাওয়ার কথা ছিল। অফিসের একজন বড় কর্তা জিজ্ঞেস করলেন এই মুহুর্তে বাংলাদেশে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। আমি সত্যিকার অর্থে কোন উত্তর দিতে পারিনি আদৌ যাওয়া উচিত হবে কিনা। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথা বলে তখনকার মতো মুক্তি পেলাম।
বাংলাদেশে প্রত্যকে সিজনেই আমাদের অর্ডার বাড়ছে। বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের বড় পরিকল্পনা আছে। এই রকম একটা সময়ে এই ধরণের একটা ঘটনা কতটা পিছিয়ে দিয়েছে যারা এই সেক্টরে কাজ করেন তারা ভালভাবেই টের পেয়েছেন। বায়াররা এখন ভয়ে সহজে বাংলাদেশে যাবে না।
ইতালি এবং জাপানে প্রচুর বাংলাদেশী প্রবাসী বসবাস করেন। অনেকেই ভাল অবস্থান করে নিয়েছেন। এখন তাদের কি অবস্থা ভাবছি। সেখানে আশেপাশের অনেকেই হয়তো বাঁকা চোখে তাকাবে। পুলিশের নজরদারি, হয়রানি বাড়বে। মানসিকভাবে আমরা প্রবাসীরা কতটা পিছিয়ে গেছি সেটা আমরা জানি। কোরিয়াতে যারা প্রবাসী আছি বেশিরভাগ প্রবাসীকেই তাদের কর্মক্ষেত্রে কলিগরা গুলশান হামলার কথা জিজ্ঞেস করেছে। লজ্জা নিয়ে কিছুটা গা বাঁচানো উত্তর দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। জাপানিজ এবং ইতালিয়ানদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর সেখানকার প্রবাসীদের কি পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। নিশ্চয়ই ঘটনার পর হয়তো অনেকেই মুখ লুকিয়ে ছিলেন, অনেকেই সবার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে উত্তর তৈরী করেছেন দিনরাত।
এখন যে আক্রমণটা গুলশানে হয়েছে, আল্লাহ না করুক, ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোকাবেলা না করলে এর চেয়ে খারাপ অবস্থা হতে পারে। ৭/৮ বছর ধরে জংগী মোকাবেলার কিচ্ছাকাহিনী পত্রিকায় পড়ি। কিন্তু জনগণ কোন ঘটনার আসল কাহিনী জানতে পারেনি। কিছু লোক দেখানো গ্রেফতার ছাড়া কোন অগ্রগতি দেখতে পাইনি।
দেশের বর্তমান চালিকাশক্তি গার্মেন্টস এং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। রানা প্লাজার পর গার্মেন্টস সেক্টর অনেক বড় একটা ধাক্কা খেল গুলশান হামলার পর। প্রবাসীরা শুরু থেকেই সংগ্রাম করে যাচ্ছে বিদেশের মাটিতে কিছু করার। ভাল কিছু করে দেশে কিছু টাকা পাঠানোর যা দিয়ে পরিবারের সদস্যরা ভালভাবে খেয়ে পড়ে চলবে। এখনি প্রতিরোধ করতে না পারলে হয়তোবা সেই সংগ্রামের সাথে এখন যুক্ত হবে জংগী তকমা। তার উপর বোনাস হিসেবে আছে সারাদিন দেশ নিয়ে চিন্তা। বোমা হামলা গুলোর পর চিন্তা দ্বিগুণ হবে এই যা!
লেখকঃ সম্পাদক, বাংলা টেলিগ্রাফ