নগরকেন্দ্রিক উন্নয়নের সুবাদে ঢাকা অভিমুখী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সরকারি হিসাবে, প্রতিদিন নতুন করে ১ হাজার ৪১৮ জন মানুষ যুক্ত হচ্ছে রাজধানীতে। বর্তমানে রাজধানীর জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে। অর্থাত্ প্রতি বর্গকিলোমিটারে এখানে বাস করছে ৪৪ হাজার ১০০ জন মানুষ, যা ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরে পরিণত করেছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত ‘ডেমোগ্রাফিয়া ওয়ার্ল্ড আরবান এরিয়াস’-এর ১২তম বার্ষিক সংস্করণে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিভিন্ন দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান ও জাতিসংঘের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোট ১ হাজার ১৭টি শহর নিয়ে তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। জরিপকালে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে স্যাটেলাইট ইমেজ।
প্রতিবেদনে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানের হায়দরাবাদ। এ শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪১ হাজার ২০০ জন। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩১ হাজার ২০০ জন নিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ শহর ভারতে অন্ধ্র প্রদেশের শহর বিজয়বাড়া। তালিকার চতুর্থ অবস্থানে আছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। শহরটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটার ২৯ হাজার ২০০ জন মানুষের বসবাস। পঞ্চম ও ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারতের মুম্বাই ও চীনের হংকং। শহর দুটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে যথাক্রমে ২৬ হাজার ও ২৫ হাজার ৬০০ জন। তালিকার সপ্তম ও অষ্টম অবস্থানে আছে ভারতের উত্তর প্রদেশের শহর আলীগড় ও চীনের ম্যাকাও। এ দুটি শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫ হাজার ৩০০ জন করে মানুষের বসবাস। তালিকার নবম স্থানে রয়েছে সিরিয়ার হামাহ। শহরটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ২৫ হাজার ১০০ জন মানুষ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫ হাজার মানুষ বাস করে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে। ঘনবসতির দিক থেকে শহরটির অবস্থান দশম।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অধীন মোট জমির পরিমাণ ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু ডেমোগ্রাফিয়ার প্রতিবেদন তৈরিতে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা, যেখানে প্রায় ১ কোটি ৬২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের বসবাস। জনসংখ্যার এ উচ্চ ঘনত্ব ঢাকা শহরের জনজীবন ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে নগর গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকার চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, উন্নয়নের মডেল এখন ঢাকামুখী। তাই সারা দেশ থেকে মানুষ ঢাকার দিকে ছুটছে। কাজের খোঁজে যারা আসছে, তারা বস্তিতে থাকছে অমানবিকভাবে। মানবেতর জীবনযাপন করছে বলেই বস্তিতে এত লোক থাকতে পারছে। ঢাকার জনসংখ্যা প্রতি বছর প্রায় ৪ শতাংশ হারে বাড়ছে। আগামীতে এটি আরো বাড়বে। এতে দুর্ভোগও বাড়বে।
তিনি বলেন, এখন দুটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত. বিনিয়োগের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। মফস্বলকেন্দ্রিক বিনিয়োগ হলে মানুষ আর শহরমুখী হবে না। তখন ঢাকার ওপর চাপ কমবে। দ্বিতীয়ত. ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে রাজউকের যে ‘ঢাকা স্ট্রাকচারাল প্ল্যান’ রয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে শক্ত হাতে। গণপরিবহন চালু ও বহুতল বাসস্থান নির্মাণ করতে হবে। নয়তো ভবিষ্যতে ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখা কঠিন হবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই বাসযোগ্য নগরীর মর্যাদা হারাচ্ছে ৪০০ বছরের পুরনো ঢাকা। যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে আগামী ২০ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা আরো ৫০-৬০ শতাংশ বাড়বে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। ২০৩০ সালের মধ্যে তা পৌঁছাবে ২ কোটি ৭৪ লাখে। অন্যদিকে ব্র্যাক ও কোপেনহেগেন কনসেনসাসের “ঢাকা’স ফিউচার আরবান ট্রান্সপোর্ট: কস্টস অ্যান্ড বেনিফিটস অব ইনভেস্টমেন্ট ইন পাবলিক অ্যান্ড প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট” শীর্ষক যৌথ গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০৩৫ সালের মধ্যে তা ২ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছাবে। আর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজউকের ‘ঢাকা স্ট্রাকচারাল প্ল্যানে’ বলা হয়েছে, ২০৩০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটি ৭০ লাখে।
রাজউকের তথ্যমতে, ১৯৪১ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২ লাখ ৪০ হাজার। এর পর থেকে ক্রমে বাড়তে থাকে ঢাকার জনসংখ্যা। এ জনসংখ্যা ১৯৫১ সালে ৪ লাখ ১১ হাজার, ১৯৬১ সালে ৭ লাখ ১৫ হাজার, ১৯৭৪ সালে ২০ লাখ ৬৮ হাজার, ১৯৮১ সালে ৩৪ লাখ ৪০ হাজার, ১৯৯১ সালে ৭১ লাখ ২৫ হাজার, ২০০১ সালে ১ কোটি ২ লাখ ৫৪ হাজার ও ২০১১ সালে ১ কোটি ৫১ লাখ ২৩ হাজারে উন্নীত হয়।
বর্ধিত জনসংখ্যার বাসস্থান নিশ্চিত করতে গড়ে উঠেছে প্রায় সাড়ে চার হাজার বস্তি। নির্মাণ করতে হয়েছে বহু ভবন। এতে কমেছে জলাভূমি, গাছপালা ও খোলা জায়গা। অপরিকল্পিত নগরায়ণে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। পরিবহনের ব্যবস্থা করতে সড়কে নামাতে হয়েছে নতুন যানবাহন। তবে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হয়নি। ফলে তৈরি হয়েছে অসহনীয় যানজট। যানবাহনের ধোঁয়া প্রতিনিয়ত দূষিত করছে ঢাকার বাতাস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ঢাকায় জলাভূমি, গাছপালা ও উদ্যান অনেক কমে এসেছে। এজন্য ভুল পরিকল্পনা ও সম্পদের প্রতি প্রভাবশালীদের লিপ্সাও দায়ী।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, নদী দখল হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে ৫৩টি খাল ছিল, যেগুলো প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে দলিলও তৈরি করে ফেলেছেন। তারা দলিল কীভাবে তৈরি করল? রাস্তার দুই ধার, খোলা জায়গা দখল করে তৈরি হয়েছে অসংখ্য দোকানপাট ও শপিংমল। সরকার দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে দুর্ভোগ আরো বাড়বে। যাতায়াত ও পানিনিষ্কাশন; এ দুটি বিষয় শক্ত হাতে জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে।বণিক বার্তা ।