অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রকৃতি দুই ধরনের ভূমিকা রাখে। প্রথমত. এটি উপাদানের ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। দ্বিতীয়ত. উন্নয়নের বর্জ্যধারণের আধার হিসেবে ভূমিকা রাখে। অনেকেই মনে করেন, প্রাকৃতিক উপকরণ ও পরিষেবা হচ্ছে প্রকৃতির অফুরন্ত দান। অর্থবিদ্যার জনক অ্যাডাম স্মিথ থেকে শুরু করে অনেক উন্নয়ন অর্থনীতিবিদই বিশ্বকে একটি খণ্ডিত ও ভুল বার্তা দিয়েছেন। তাদের পর্যবেক্ষণ— আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশের কথা ভাবা যাবে। দেশের উন্নয়নের আশু চাহিদা মেটানোর জন্য স্বল্পকালীন দূষণকে দীর্ঘকালীন দূষণমুক্তির শর্ত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা রয়েছে অনেকের বিশ্লেষণে।
কিন্তু এসব ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ পৃথিবীতে ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন, বিলীয়মান পানিসম্পদ, ভূসম্পদ, প্রাণসম্পদ, জীববৈচিত্র্য কীভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যয়বহুল ও বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করে তুলেছে, তা নিয়ে চলছে বিশ্বে নানা গবেষণা ও পাঠদান। ১৮৮০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর জল-স্থলভাগের তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় দশমিক ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অনেক প্রাণী হারিয়ে গেছে, আবার অনেকে তাদের আবাস পরিবর্তন করেছে। বেইজিংয়ের আকাশ ধোঁয়ায় ঢাকা। অনেক শহর অতিবর্ষণে কোমরসমান পানির নিচে। ঢাকাসহ পৃথিবীর অনেক শহর বায়ুদূষণ সহনশীল মাত্রার অনেক ওপরে উঠে গেছে। এ থেকে পৃথিবীর তাবত্ দেশ ও রাজনৈতিক নেতারা উত্তরণের পথ খুঁজছেন।
দুই বছর অন্তর যৌথভাবে এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই) প্রকাশ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়েল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল অ্যান্ড পলিসি ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল আর্থ সায়েন্স ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক। জনস্বাস্থ্যের ওপর দূষণের প্রভাব, বায়ুর মান, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, পানিসম্পদ, কৃষি, বনায়ন, মত্স্যসম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও বাসস্থান এবং আবহাওয়া ও জ্বালানি— এ আটটি বিষয় বিবেচনায় ইপিআই সূচকটি প্রণয়ন করা হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত ইপিআই ২০১৬ বলছে, সূচকে সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ১০টি দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। সূচকে সর্বনিম্নে থাকা বাকি দেশগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত বা আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত। তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৩তম। আর স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৪১ দশমিক ৭৭। এর আগে ২০১৪ সালের সূচকে বিশ্বের ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৯তম।
পরিবেশ-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বণিক বার্তাকে বলেন, এ দেশের পরিবেশের করুণ চিত্রের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। নদী দখল হচ্ছে, বনাঞ্চল উজাড় করা হচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল। সুশাসনের অভাবে এগুলো হচ্ছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরাই অনেক ক্ষেত্রে দূষণকারী হয়ে উঠছে। এসবের প্রভাব দেখা গেছে বৈশ্বিক পরিবেশ সূচকে।
তথ্যমতে, ৫০ বছরে দেশের বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে দুই-তৃতীয়াংশ। কক্সবাজারের চকরিয়ার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের প্রায় ছয় হাজার হেক্টর এখন বিরানভূমি। এক দশক আগেও গাজীপুরে মোট জমির প্রায় ১৪ শতাংশ ছিল বনাঞ্চল। এক দশকের ব্যবধানে বনাঞ্চল নেমে এসেছে মাত্র ৩ শতাংশে। রেহাই পায়নি সুন্দরবনও। গত ৪০ বছরে বিলীন হয়েছে ১২৭ বর্গকিলোমিটার।
বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ায় বিলুপ্ত হচ্ছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। এক দশকে দেশে শুধু বাঘের সংখ্যাই কমেছে তিন-চতুর্থাংশ। সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৬। অথচ ২০০৪ সালেও এ সংখ্যা ছিল ৪৪০।
দখল আর দূষণে এখন মৃতপ্রায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরের পার্শ্ববর্তী নদ-নদীগুলো। এক যুগের কিছু বেশি সময়ে ঢাকার চারদিকের নদ-নদীর ২৫০ একরের বেশি দখল হয়ে গেছে। আর ঢাকার ভেতরে সাড়ে তিন দশকে হারিয়ে গেছে ১০ হাজার হেক্টর বা ৫০ শতাংশের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল। এতে গড়ে উঠেছে সড়ক, অবকাঠামোসহ নানা স্থাপনা।
বন আর নদীই শুধু নয়, দেশের বিভিন্ন শহরের বায়ুও দূষণের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। সিসা আর সালফারে ভারী হয়ে উঠছে শহরের বাতাস। আর কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের পাশে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে সুউচ্চ ভবন।
এছাড়া বিশ্বের অন্যতম বৃহত্ এ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের কাছেই গড়ে তোলা হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র। যদিও বিশেষজ্ঞরা বারবার এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। আর সুন্দরবনের ভেতরের নদী দিয়ে চলতে গিয়ে দেড় বছরের মধ্যে ডুবেছে একাধিক তেল ও কয়লাবাহী জাহাজ। সব মিলিয়ে সমগ্র দেশের পরিবেশই বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত প্রভাব পড়েছে ইপিআইয়ে।
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব পরিবেশে পড়ছে। আবাসনের জন্য বনাঞ্চল কমে যাচ্ছে। দেশের নাগরিকরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলছে। তাই পরিস্থিতির উন্নয়নে মানুষের অভ্যাসে পরিবর্তন আনা দরকার। এছাড়া পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে প্রচুর বিনিয়োগও প্রয়োজন।
ইপিআইয়ে র্যাংকিংয়ে সবার নিচে (১৮০) রয়েছে সোমালিয়া। ১৭৯-১৭৪তে রয়েছে যথাক্রমে ইরিত্রিয়া, মাদাগাস্কার, নাইজার, আফগানিস্তান, শাদ ও মালি। শেষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে মোজাম্বিক ১৭২ ও কঙ্গো ১৭১।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলংকা। ৬৫ দশমিক ৫৫ স্কোর নিয়ে দেশটির অবস্থান ১০৮। এর বাইরে ভুটান ১১০, মালদ্বীপ ১৩৭, ভারত ১৪১, পাকিস্তান ১৪৪ ও নেপাল ১৪৭তম অবস্থানে রয়েছে।
৯০ দশমিক ৬৮ স্কোর নিয়ে সবার শীর্ষে রয়েছে স্ক্যান্ডিনেভীয় অঞ্চলের দেশ ফিনল্যান্ড। একই অঞ্চলের দেশ আইসল্যান্ড ৯০ দশমিক ৫১ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ৯০ দশমিক ৪৩ স্কোর নিয়ে সুইডেন তৃতীয়। এর বাইরে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে ডেনমার্ক, স্লোভেনিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, এস্তোনিয়া, মাল্টা ও ফ্রান্স।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরার পাশাপাশি পানি সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মধ্যে ৮৫ শতাংশ নাগরিকের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করায় জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবে পানির এসব উেস সংক্রমণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকটি স্থান পায়নি। আর এ অপরীক্ষিত খাওয়ার পানি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল-আলম বলেন, নিরাপদ পানির জন্য প্রয়োজন নিরাপদ উত্স। সেটিই যদি পরীক্ষা করা না হয়, তাহলে আমরা পানিকে নিরাপদ বলতে পারি না। পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান থাকে। এসবের পরীক্ষা করা অতিজরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে পরিবেশ সূচকে পিছিয়ে থাকার এটাও আরেকটি কারণ। বণিক বার্তা ।