যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ নিয়ে পৃথিবীর বুকে দরিদ্রতম রাষ্ট্রগুলোর একটি হিসেবেই যাত্রা শুরু করেছিল দেশটি। সেও খুব বেশীকাল আগের কথা নয়। স্বাধীনতার ৬৫ বছরে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ কোরিয়া আজ বিশ্বের একাদশ বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। জীবনযাত্রার মান সূচকে ঊর্ধ্বগতি, নগরজুড়ে আকাশচুম্বী অট্টালিকার সারি, প্রযুক্তি খাতে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি, বিশ্ব রাজনীতিতে শক্ত আসন, কোরিয়ান সংস্কৃতির দুনিয়াজোড়া বিস্তার…সামান্য সময়ে সবই কোরিয়ানদের অসামান্য যত অর্জনের কিছু নমুনামাত্র।
উন্নত জীবনের সন্ধানে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত বিশ্বের মানুষ এখন আর কেবল ইউরোপ-আমেরিকাতেই ছোটে না। বিদেশে পাড়ি জমানোদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা বর্তমানে ভিড় জমাতে শুরু করেছে কোরিয়াতেও। পরিসংখ্যান বলে অংকটা কেবল বাড়ছেই। সেই ভিনদেশীদের চোখে কেমন আছে কোরিয়া? তাঁদের মতে স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশটির অর্জন আদতে কতোটুকু? স্থানীয় দৈনিক কোরিয়া টাইমসের এক আয়োজনে কোরিয়ার অভিবাসীরা ভাগাভাগি করেছেন তাঁদের প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, জানিয়েছেন কেমন আছেন তাঁরা ‘জসন’ বা ‘প্রভাতকালীন প্রশান্তি’র দেশে।
বর্ণবাদ ও বিদেশীবিদ্বেষ: অন্তত প্রথম দর্শনে কোরিয়াকে বর্ণবাদী বা বিদেশীভীতিতে আক্রান্ত বলে মনে হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে কোরিয়ান টিভি অনুষ্ঠান, নাটক আর সিনেমাসমূহেও আলাদা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বিদেশীদের।
“কোরিয়ানরা মানুষ হিসেবে খুবই আন্তরিক। ভাষাগত সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে তাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে মুখিয়ে থাকে।” বলছিলেন মার্কিন পর্যটক জ্যানেট মিশেল, “খুব খুশী হতাম যদি এখানে আরও কিছুদিন থাকতে পারতাম। আমি অন্তত এখানে কোনরূপ বর্ণবাদী আচরণের মুখোমুখি হই নি।”
অবশ্য কোরিয়ায় অবস্থানরত সকল বিদেশীর অভিজ্ঞতা এমন সুখকর নয়। দীর্ঘদিন ধরে কোরিয়ায় আছেন এমন অনেকেই কোরিয়ানদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী বা বিদ্বেষী আচরণের অভিযোগ তুলেছেন। হঙ্গিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক বেঞ্জামিন জোনা যেমন বলছিলেন, “খুব সূক্ষ্ম আর পরোক্ষ হলেও ব্যাপারটা কোরিয়াতে আছে। একবার এখানে একটি পাবলিক বাথহাউজে আমাকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় নি এই বলে যে, বিদেশীদের গায়ের গন্ধে পানি নষ্ট হয়ে যাবে!”
আয়োজনে অংশ নেয়া বিদেশীদের অভিজ্ঞতা বলছে পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিক যারা কিনা কোরিয়ান ভাষাটা ভালো বলতে পারেন তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ প্রদর্শনের নজির কম। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ থেকে আগত, কোরিয়ান ভাষাতেও দখল কম এমন বিদেশীরা পদে পদে নানারকম হেনস্থার শিকার হন।
সিউল ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা শিক্ষার্থী ইয়ুন বোয়াও ভিনদেশী হিসেবে আজতক কোন সমস্যায় পড়েন নি, “কারণটা সম্ভবত আমি দেখতে কোরিয়ানদের মতোই, আবার তাঁদের ভাষাটাও অনর্গল বলতে পারি।”
কলিন ব্রাউন পেশায় একজন সঙ্গীতজ্ঞ। ২৯ বছর বয়সী এই মার্কিন নাগরিকের বর্তমান আবাস কোরিয়া, “কোরিয়ান ভাষায় আমার সাবলীলতায় এখানকার মানুষজন প্রথমে বেশ প্রীত হয়। কিন্তু সমাজে , কর্মক্ষেত্রে কোরিয়ানদের সাথে মিশতে গেলে সেটা আবার ভিন্ন গল্প। উপড়ে উঠতে চাইলে সবসময়ই মনে হয় অদৃশ্য কোন প্রতিবন্ধকতায় বারবার আটকে যাচ্ছি।”
বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্টের এক জরিপের ফল অবশ্য আরও শোচনীয় পরিস্থিতির ইঙ্গিতবহ। ওই জরিপ প্রতিবেদনে কোরিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে কম বর্ণবাদ সহনশীল দেশগুলোর একটি হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়, এখানে প্রতি তিনজনে একজন কোরিয়ান ভিন্ন বর্ণের কাউকে প্রতিবেশী হিসেবে পেতে চান না।
হালিউ: নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে কোরিয়ান অপেরা ধারাবাহিকগুলোর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার ফসল হিসেবে উঠে আসে হালিউ বা ‘কোরিয়ান ঢেউ’। বর্তমানে ইউটিউবসহ সামাজিক নানা মাধ্যমে কোরিয়ান পপ সংগীতের দুনিয়াজোড়া খ্যাতির সুবাদে ‘হালিউ’ এখন হয়ে উঠছে হালের সেনসেশন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে র্যাপার সাইয়ের ‘খাংনাম স্টাইল’ গানটি প্রথম মিউজিক ভিডিও হিসেবে ১০০ কোটি বার দেখা হয়।
লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট সম্প্রতি হালিউকে এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত প্রসারমান ‘ট্রেন্ড’ হিসেবে অভিহিত করেছে। কোরিয়া সরকারও এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে দেশটির বিনোদন শিল্প তথা রপ্তানি খাতকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে কোরিয়া টাইমসের সাক্ষাৎকার পর্বে অংশ নেয়া বিদেশীদের অধিকাংশই ‘হালিউ’র স্বরূপ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যক্ত করেছেন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। “কে-পপ একটা কারখানার মতো মনে হয়। শিল্পী যায়, শিল্পী আসে…কিন্তু পদ্ধতি আর বদলায় না। একইরকম গান বারবার তৈরি হচ্ছে”, বলছিলেন মার্কিন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এলিজাবেথ স্টেওয়ার্ট।
তাঁর সাথে একমত একটি রেস্তোরার ম্যানেজার অ্যান্ড্রু পার্ক, “হংকংয়ের কথা মনে আছে? ক’বছর আগে কিভাবে তাঁরা খুব জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল জানেন তো? তাঁরা তখন ভেবেছিল জনপ্রিয়তা তো পাওয়াই গেছে। সুতরাং তাঁরা একই ধাঁচের ভিডিও আর সিনেমা বানানো শুরু করলো। ফলস্বরূপ, প্রতি বছর তাঁদের কাজের মান কেবল খারাপই হয়েছে।”
৩২ বছর বয়সী অ্যালেন পার্ক কোরিয়ায় এসেছেন পড়াশুনা করতে। ‘হালিউ’ তাঁকে কোরিয়ান সংস্কৃতির ব্যাপারে বেশ নেতিবাচক একটা বার্তাই দিচ্ছে, “আমার বিশ্বাস কোরিয়ানরা এসব থেকে পয়সা বানানোর দিকেই বেশী মনোযোগ দিচ্ছে। একদল অর্ধনগ্ন তরুণী মঞ্চে উঠে কোমর দুলিয়ে নাচছে- আমার মনে হয় না এটা কোরিয়ানদের জন্য গর্ব করার মতো কিছু কিংবা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে এসবকে তাঁদের উৎসাহিত করা উচিৎ।”
ফ্রেডেরিক ক্রিব, ৩০ বছর বয়সী এই অস্ট্রেলিয়ান থাকেন সেন্ট্রাল সিউলে। এভাবে চলতে থাকলে ‘কোরিয়ান ওয়েভ’-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করলেন, “এ ধরণের ঢেউ আসবে-যাবে, একসময় মরেও যাবে যদি সংস্কৃতির প্রকৃত ধারকরা যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা না পায় – যেমন স্বাধীনচেতা শিল্পী, মঞ্চ অভিনেতা, কারিগর প্রমুখ।”
প্রকৃত অর্থেই একই ধাঁচের নাটক আর সিনেমায় ‘হালিউ’র জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। চীনা শিক্ষার্থী ইয়ুন পরামর্শ দিচ্ছেন গল্পে বৈচিত্র্য এনে সে ধ্বস ঠেকানোর, “কোরিয়ান চলচ্চিত্র ‘দ্য এটর্নি’ চীনে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল। এই ছবিতে কোরিয়ান সমাজের অন্ধকার একটা দিক তুলে ধরা হয়েছিল যেটা আমাদের দেশের মানুষ খুব পছন্দ করেছিল। পরিচালকের সাহস চীনাদের মুগ্ধ করেছিল। কেননা এসব ইস্যুতে হাত দেয়ার সাহস অন্তত চীনে কারও হবে না। এ ধরণের সিনেমা বা নাটক আমি আরও দেখতে চাই।”
গণতন্ত্র ও সামাজিক সচেতনতা: অভিজ্ঞতা বিনিময়ে কোরিয়ায় বসবাসরত বিদেশীদের অনেকেই অন্য যে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন সেটি হল দেশটির গণতন্ত্র ও সামাজিক সচেতনতা। কোরিয়ানরা তাঁদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে নিজেরা বেশ তৃপ্ত। এ অব্যাহত অর্জনের তাঁরা আলাদা একটা নামও দিয়েছে, ‘হান নদীর যাদু’। কিন্তু অভিবাসীরা এখনই যাদুকরী কোন উন্নয়ন লক্ষ্য করছেন না, কোরিয়াকে এখনও তাঁদের বেশীরভাগ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবেই দেখেন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন গণতন্ত্রের নিম্নমান ও দুর্বল সামাজিক সচেতনতার কথা। বিদেশীদের বিশ্বাস এসব খাতে কোরিয়ার আরও অনেক পথ যাবার বাকি আছে।
“আমি কোরিয়াকে পুরো মাত্রায় গণতান্ত্রিক দেশ মনে করি না,” ভাষ্য ২৮ বছর বয়সী লেবাননি শ্রমিক মাজেন মোস্তফার, “বরং মনে হয় দেশটা গুটিকয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তির কবজায় বন্দী। ব্যবসায়িক প্রতিপত্তিসম্পন্ন কোন পরিবারে জন্ম দিলে আপনি এ দেশে আজীবন ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যাবেন যেখানে কিনা একজন প্রধানমন্ত্রী মাত্র পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকেন।”
অবশ্য মার্কিন তরুণী লিন্ডা সুল মনে করেন কোরিয়ার আরও সময় দরকার, “বছর কয়েক আগে একবার কোরিয়ার সংসদে রাজনীতিবিদদের মারামারি দেখেছিলাম। এই তেজটা আমার ভালো লাগে। আমি মনে করি কোরিয়ানরা নিজেদের মতো করে গণতন্ত্রটাকে বেশ দক্ষ হাতেই এগিয়ে নিচ্ছে। আমেরিকার আজকের অবস্থানে আসতে দু’শ বছর লেগে গেছে এবং এখনও লোকে সেখানকার গণতন্ত্রের কাঠামো নিয়ে সমালোচনা করে।”
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসী অধ্যাপক জোনাও একমত লিন্ডার সাথে, “ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখবেন কোরিয়া এসব ইস্যুতে খুব খারাপ অবস্থানে নেই। সামাজিক সচেতনতা একটা জিনিস যেটা শিক্ষা থেকে নৈতিকতাবোধ ও ব্যক্তিগত আচরণের মাধ্যমে তৈরি হয়। দৃশ্যমান পরিবর্তন আসতে এক প্রজন্ম এমনকি কখনও কখনও তারচেয়েও বেশী সময় লাগে। সময়ই সব বলে দেবে।”
প্যাট্রিক সুল, ৫৫ বছর বয়সী এই মার্কিন নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা; “আমি বিশ্বাস করি অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে একটি দেশের শিল্পায়নের সংখ্যাতাত্ত্বিক ফলাফল। কিন্তু গণতন্ত্র চর্চা ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি একটা গুনগত প্রক্রিয়া যেটা ঠিক আমদানি-রপ্তানির ব্যাপার না।”
কোরিয়ার গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস প্যাট্রিককে আশাবাদী করছে দেশটিতে আরও উন্নত আগামীর, “আজকের কোরিয়া কুড়ি বছর আগের কোরিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিক্ষা অনেক বড় একটা ভূমিকা রেখেছে দেশটির পরিবর্তনে। দখলদারিত্ব, যুদ্ধ, শোষণ-নিপীড়নের মতো নানা প্রতিবন্ধকতা সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল; কিন্তু কোরিয়া সবই সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করেছে। আমার বিশ্বাস অনাগত ভবিষ্যতেও দেশটি অনেক ভালো করবে।”