বাংলাদেশে সরকারি আদমশুমারি অনুযায়ী হিন্দু জনসংখ্যা প্রতি বছরই কমছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় বৈষম্য এবং নির্যাতনের মুখে এদের বেশিরভাগই ভারতে চলে যাচ্ছেন। হিন্দুদের দেশ ছাড়ার কারণ খুঁজতে গোপালগঞ্জের এক হিন্দু অধ্যূষিত গ্রামে গিয়েছিলেন বিবিসির আবুল কালাম আজাদ।
গোপালগঞ্জ জেলার উলপুর গ্রামের কালীমন্দিরের পুরোহিত সন্তোষ কুমার ভট্টাচার্য। জমিদার হিমাংশু রায়ের রেখে যাওয়া বাড়িতেই জন্ম তার। সপরিবারে এই পুরোনো বাড়িতেই এখনো বসবাস করছেন। সন্তোষ কুমার ভট্টাচার্য বলছিলেন, “এক সময় উলপুর গ্রামটি ছিল শত ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত। কিন্তু এখন হিন্দুদের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে, গ্রামের জনসংখ্যার বেশিরভাগই মুসলিম।”
“হিন্দুদের যাওয়ার গতি দেখে মনে হচ্ছে এখনো অনেকে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও যাবে”, বলছিলেন তিনি। কিন্তু কারণটা আসলে কি? কেন হিন্দুরা দেশ ছাড়ছেন? “কারণ… হয়তো এখানে তাদের স্বাধীনতা নেই। সেটাই মনে করে।”
গ্রামের বাজারে কাঁচি হাতে চুল কাটায় ব্যস্ত ক্ষৌরকার নিখিল সরকার। গত ৪০ বছর ধরে এটাই তার পেশা। তিনি বলছিলেন, মূলত নিরাপত্তার কথা ভেবেই অনেকেই ভারতে পাড়ি জমানোর একটা পথ খোলা রাখেন।
“মনে করেন যে এই পাশেও আছে, আবার হয়তো ওই পাশেও (ভারতে) ছেলে-পেলে পাঠায়ে দেছে, ভাই-বেরাদার পাঠায়ে দেছে। অহনে এখানে যারা আছে, তারা শান্তিতে নাই, একটা দোটানার মধ্যে আছে।”
এই শান্ত সবুজ গ্রামটার বিভিন্ন পাড়ায় চোখে পড়বে অনেক পুরনো দালান-কোঠা। আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট এসব বাড়ি ঘরে। এক সময়ের হিন্দু জমিদার এবং সম্ভ্রান্ত অনেক হিন্দু পরিবার তাদের এসব ভিটে-বাড়ি ফেলে একদিন পাড়ি জমিয়েছিলেন ভারতে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর এই দেশ ছাড়ার হিড়িক শুরু হয়েছিল। সেই ধারা এখনো থামেনি। বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ আদম শুমারির হিসেবেই গোপালগঞ্জ জেলায় গত দশ বছরে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে প্রায় ১৮ হাজার। সারা দেশে এই সংখ্যায় প্রায় নয় লাখ।
উলপুর দক্ষিণপাড়ার রায় বাড়িতে বসে এই সমস্যা নিয়ে কথা হচ্ছিল কয়েকজন গৃহিণীর সঙ্গে।
“ভবিষ্যতে চলে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। ছেলে-মেয়ে বড় হচ্ছে। এদের ছেলে-মেয়েদের আর এদেশে রাখার ইচ্ছে নাই।” বলছিলেন একজন।
“আমারও ওই একই কথা। আমাগো দিন তো চলি গেল। কিন্তু আমাগো যে নাতি-পুতি, এগো ভবিষ্যত তো এই জায়গায় হবি না,” বললেন তার সঙ্গে থাকা আরেক জন। আলাপে আলাপে উঠে আসে তাদের নিরাপত্তাহীনতা আর আতংকের বিষয়গুলি। দেশ ছাড়ার এরকম ইঙ্গিত থাকলেও ভারতে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার আগে কেউই বিষয়টি প্রকাশ করতে চান না।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা কাজল দেবনাথ বলছিলেন কিভাবে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যার হার কমছে।
“১৯৫১ সালে যে আদমশুমারি ছিল তাতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২২ শতাংশ। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারিতে এটা নেমে আসলো ১৪ শতাংশে। আর সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে এটা নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশে।”
“দেশ ছাড়া কোন সমাধান নয়। আমাকে আমার মাতৃভূমিতে শক্ত করে দাঁড়াতে হবে। আমার কথাটি শক্ত করে বলতে হবে।”
পুজার ঢোল বাজছে, সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দূর্গোৎসবে সামিল হয়েছেন। এবার পুজা মন্ডপের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। কিন্তু এই উৎসবের আনন্দের মাঝেও সবাই জানেন, প্রতি বছর মণ্ডপে পুজারির সংখ্যা কমছে, হারিয়ে যাচ্ছে অনেক চেনা মুখ। -বিবিসি