ইংল্যান্ডের লুটন শহরের একটি আলোচিত নাম নাদিয়া হোসেন। অসাধারণ কেক প্রস্তুতকারী হিসেবে সুনাম অর্জনকারী নাদিয়া ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ মুসলিম তরূণীদের রোল মডেলে পরিণত হয়েছেন। বিশেষ করে লুটনের সকলেরই ভালোবাসার পাত্রী তিনি।
তিন সন্তানের জননী, সদালাপী, চৌকস, চিত্তাকর্ষক হাসির অধিকারিণী ও হিজাব পরিহিত নাদিয়া এ সপ্তাহের ‘বিবিসি সেরা ব্রিটিশ বেকার’ পুরষ্কারের জন্য হট ফেভারিট বলে বিবেচিত হচ্ছেন।
ফলে যারা নাদিয়াকে চোখের সামনেই স্কুলবালিকা থেকে উদীয়মান টিভি তারকায় পরিণত হতে দেখেছেন তারা গর্বে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন।
বেডফোর্ডশায়ার শহরে নাদিয়া হোসেনের পরিবারের ৩৯ বছর বয়সী প্রতিবেশী দিপালি প্যাটেল বলেন, ‘স্কুলে যাওয়ার বয়স থেকেই সে কেক তৈরি করতো এবং তার বানানো ‘গাজর কেক’ দারুন সুস্বাদু। সে খুব ভালো মেয়ে। আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত।’
ছোট্ট শহরটির মেয়েটি ভালো করছে বলে গর্ব হচ্ছে-বিষয়টা শুধু এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। লিউটনের মুসলিম সম্প্রদায় তাকে নিয়ে গর্বিত এ কারণে যে তাদেরই একজনকে নিয়ে কোনো খারাপ প্রচারণা বদলে দেশজুড়ে আলোচনা হচ্ছে।
শহরটিতে অভিবাসী জনসংখ্যা প্রচুর। বিশেষকরে ঊনিশ’ পঞ্চাশের দশক থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এখানে এসে বহু পরিবার বসতি স্থাপন করেছে।
ত্রিশ বছর বয়সী নাদিয়া যেখানে বেড়ে উঠেছেন সেই বারি পার্কের আশেপাশেই রয়েছে বহু হিন্দু ও মুসলিম, ভারতীয়, বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানি। তারা এখানে ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছেন এবং একত্রে বসবাস, খাওয়া-দাওয়া, কাজকর্ম এবং নামাজ আদায় করছেন।
এই শহরের ডানস্টাবল রোডের দোকানগুলোতে পাওয়া যায় উজ্জ্বল রঙের শাড়ি আর বড় থলে ভর্তি চাল-যা অনেক এশীয়র প্রিয়।
লুটনের অনেকের কাছে হিজার পরিহিত মেয়েটি দারুণ পরিচিত। তার নিমকি, চকোলেট আর উদ্ভাবনশীল চিজকেক তৈরির দৃশ্য যখন টিভিতে সম্প্রচার হয়েছে তখন তা তাদের কাছে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
গত সপ্তাহে রেডিও টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নাদিয়া বলেন, আমি প্রথাগত কোনো ব্রিটিশ না হলেও এর মানে এই নয় যে পতাকা, কেক বা চায়ে আমি নেই। আমি অন্য ব্রিটিশদের মতই এবং আমি আশা করি আমি সেটা প্রমাণ করতে পেরেছি।’
বুধবারের চূড়ান্ত পর্বে নাদিয়ার সফলতায় লুটনের তরুণী মুসলিমরা, বালিকারা দারুণ উজ্জীবিত। নাদিয়ার মতই হিজাব পরছেন বেডফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যিালয়ের আর্টের ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী মো। তারা উভয়ই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।
হিজাব পরা একজন তরুণীকে কেক তৈরির অনুষ্ঠানে দেখে মো-এর মত অনেকে ব্রিটিশই বিস্মিত হয়েছেন।
নাদিয়ার স্বামী আবদাল একজন কারিগরি ব্যবস্থাপক। সন্তানদের নিয়ে তারা লিডসে বাস করেন।
উন্নত জীবনের আশায় ব্রিটেনে এসেছিলেন তারা। নাদিয়া চালনি গার্লস হাই স্কুলে অধ্যয়ন করেন। স্কুলটি তার বাসা থেকে সামান্য পায়ে হাঁটার দূরে অবস্থিত।
তারে সাবেক শিক্ষক নাদিয়াকে একজন মনোযোগী এবং নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রী হিসেবে বর্ণনা করেন। স্কুল শিক্ষক জন মার্শালের কাছে থেকে প্রথম পাচকগিরি শেখেন নাদিয়া।
নাদিয়া জানান, বাংলাদেশের রেস্তোরাঁয় সাধারণত আইসক্রিম পরিবেশন করা হয় না। কিন্তু তারা বাবা যখন লুটনে তার রেস্তোরাঁয় এটি সরবরাহ করতেন তাতে তিনি অবাক হতেন।
পরে জন মার্শাল নাদিয়াকে তার বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ কেক, প্যাস্ট্রি ও পুডিং তৈরির উৎসাহ দেন যদিও নাদিয়াদের বাসায় তখনও কোনো ওভেন ছিল না।
পরে তার উৎসাহে নাদিয়া বাড়িতে এসব তৈরি শুরু করলে তার পরিবার খুশি হয়, বিশেষ করে তার ভাই ও বোনেরা।
চালনি হাই স্কুলের পড়া শেষ করে নাদিয়া লুটন সিক্সথ ফর্ম কলেজে ভর্তি হন এবং ২০০৩ সালে ইংরেজি, মনোবিজ্ঞান এবং ধর্মীয় শিক্ষায় এ লেভেল অর্জন করেন।
নাদিয়ার ইংরেজি ভাষার শিক্ষক পল ক্রস্টন বলেন, ‘সে তেমন একটা বদলায়নি। আমি স্মরণ করতে পারি যে সে ভীষণ রকম ভদ্র, বন্ধুবৎসল এবং অমায়িক। আপনি খাওয়ার জন্য যে ধরনের লোকের ওপর নির্ভর করতে চান সে তেমনই একজন।’
নাদিয়ার কান্না, তার প্রাণ খোলা হাসি, তার কৌতূক, তার একাগ্রচিত্ত্বতা এই প্রতিযোগিতার দশর্কদের দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। সূত্র: টেলিগ্রাফ