অদ্ভুত এক দেশ উত্তর কোরিয়া। আরও অদ্ভুত সে দেশের ৩১ বছর বয়সী রাষ্ট্রপ্রধান কিম জং উন। যে কিনা সামরিক বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে বিমান বিধ্বংসী কামানের গোলায় দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিওন ইয়ং চলের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে। আরও বিস্ময়কর যে, নিজের আত্মীয় স্বজনদেরও একের পর এক নির্মমভাবে হত্যা করে চলেছে এ নেতা।
উত্তর কোরিয়া উত্তর-পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র যা কোরীয় উপদ্বীপের উত্তর অর্ধাংশ নিয়ে গঠিত। উত্তর কোরিয়ার উত্তরে গণচীন, উত্তর-পূর্বে রাশিয়া, পূর্বে জাপান সাগর, দক্ষিণে দক্ষিণ কোরিয়া এবং পশ্চিমে পীত সাগর অবস্থিত। দেশটির আয়তন ১লাখ ২০হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার। উত্তর কোরিয়ার জনসংখ্যা ৩ কোটির কাছাকাছি। সাক্ষরতার হার শতভাগ। উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রটি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সোভিয়েত সামরিক বাহিনী কোরীয় উপদ্বীপের উপরের অর্ধাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ১৯৫০-এর দশকের কোরীয় যুদ্ধের পর থেকে এটি সমাজতান্ত্রিক শাসনের অধীনে রয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহরের নাম পিয়ং ইয়ং। উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া মধ্যবর্তী অবস্থিত কোরীয় সেনামুক্ত অঞ্চল ও প্রাবর অঞ্চল। আম্নোক নদী এবং তুমান নদী উত্তর কোরিয়া এবং গণচীন এর মধ্যবর্তী সীমান্তে অবস্থিত। তুমান নদী একটি অংশ একেবারে উত্তর-পূর্ব অংশে রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। অবিভক্ত কোরিয়া মূলত জাপানিদের দখলে ছিল। ১৯৪৫ সলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার সময় জাপানিরা সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার ফলে অবিভক্ত কোরিয়া ২ ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তখন উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ সালে সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শে সমাজতান্ত্রিক ব্লকে চলে যায়, অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া পুঁজিবাদি আমেরিকার মতাদর্শে পুঁজিবাদি ব্লকে যোগদান করে। তখন থেকে কোরিয়ার ২টি ভিন্ন নাম উত্তর ও দক্ষিণ। দুটি দেশ ভিন্ন অথনৈতিক ব্যবস্থাতে চলতে শুরু করে। দক্ষিণ কোরিয়াতে আমেরিকার পুঁজিবাদ আর উত্তর কোরিয়াতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মত সমাজতন্ত্রবাদ চালু হয়।
সমাজতান্ত্রিক ও মার্ক্সবাদী নেতা কিম ইল সংয়ের নেতৃত্বাধীন কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির নিয়ন্ত্রণে উত্তর কোরিয়ায় একদলীয় শাসন চালু হয়, মূলত যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশকে পুনর্গঠনের জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নেয়া হয়। তারপর থেকে উত্তর কোরিয়া উন্নত হতে শুরু করে সমাজতান্ত্রিক পথে। কিন্তু এ উন্নতি সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়ায় বাজার অর্থনীতির প্রবক্তা আমেরিকা তা মেনে নিতে পারেনি। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থা সাংবিধানিক ভাবে একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলেও দেশটি কার্যত একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থাতে পরিচালিত হয়। উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন হচ্ছেন কিম জং ইলের (১৯৪১-২০১১) চতুর্থ সন্তান ও কিম ইল সাং-এর (১৯১২-১৯২৪) নাতি। তিনি বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির প্রথম সম্পাদক, উত্তর কোরিয়ার কেন্দ্রীয় সামরিক সংস্থার সভাপতি, উত্তর কোরিয়ার জাতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থার সভাপতি, কোরিয়ান পিপলস আর্মির সর্বোচ্চ অধিনায়ক ও কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতিমন্ডলীর নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বাবা অর্থাৎ কিম জং ইলের রাজ্য অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর তিনি ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ নিজেকে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি তার বাবা কিম জং ইল ও মা কো ইয়ং হীর তৃতীয় ও সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। কিম জং ওনের নেতৃত্বে কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টিই হল দেশটির একমাত্র শাসক রাজনৈতিক দল। দেশের সরকার ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নীতির উপর ভিত্তি করে গঠিত। সংবিধানে গণতান্ত্রিক সরকারের কথা বলা হলেও কিম জং ওন ও মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতা দেশটি পরিচালনা করেন। দেশটিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। এছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন দেশটির পর্যটন কেন্দ্রগুলো সরকার দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। পশ্চিমা বিশ্বে দেশটি একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হলেও মার্ক্সবাদ বা লেনিনবাদ নয়, স্বনির্ভরতা হল দেশটির বর্তমান সরকারি রাজনৈতিক দর্শন।
এদিকে ২০১০ সালের শেষ দিক থেকেই কিম জং উন রাষ্ট্রের পরবর্তী উত্তরাধিকারের মতো আচরণ শুরু করেন, এবং তার বাবার মৃত্যুর পর কিমকে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন “মহান উত্তরাধিকারী” হিসেবে ঘোষণা করেন। কিম জং ইলের একটি স্মরণ সভায় উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম পিপলস এস্যাম্বলির সভাপতি কিম ইয়ং নাম ঘোষণা করেন; “সম্মানিত কমরেড কিম জং উন, আমাদের দল, সামরিক বাহিনী ও দেশের সর্বোচ্চ নেতা, যিনি মহান কমরেড কিম জং ইলের আদর্শ, নেতৃত্ব, চরিত্র, গুণাবলী, সাহসিকতা ও বীরত্বের উত্তরাধিকারী লাভ করেছেন।” ২০১১ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতিমন্ডলীর নিয়ন্ত্রণ কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে, কিম জং উনকে কোরিয়ান পিপলস আর্মির সর্বোচ্চ অধিনায়ক পদে নিযুক্ত করেন। ২০১২ সালের ১১ই এপ্রিল চতুর্থ দলীয় সম্মেলনে তাকে সদ্য সৃষ্ট পদ কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির প্রথম সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাকে ২০১২ সালের ১৮ জুলাই কোরিয়ান পিপলস আর্মিতে সেনাপতি পদে উন্নীত করা হয় এর ফলে তার সর্বোচ্চ অধিনায়ক পদটি আরও দৃঢ় হয়। তার দুটি ডিগ্রি রয়েছে, একটি কিম ইল সাং বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের ওপর, আরেকটি সেনা কর্মকর্তা হিসেবে কিম ইল সাং সামরিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ৩১ বছর বয়সে, বর্তমানে তিনি পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান। ২০১২ সালের ২৫শে জুলাই উত্তর কোরীয় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম প্রথমবারের মতো কিম জং ইলের বৈবাহিক সম্পর্ক প্রকাশ করেন। এতে বলা হয় কিম রি সোল জু’কে ২০০৯ সালে বিয়ে করেন এবং ২০১০ সালে কন্যা সন্তান জন্ম দেন।
কোরীয় উপদ্বীপের সাম্প্রতিক উত্তেজনা ঘিরে সবার নজর এখন উত্তর কোরিয়ার তরুণ নেতা কিম জং উন এর দিকে। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদেশগুলোকে শুধু হুমকি দেয়ায় নয় ভয়ংকর আরো অনেক কাজ করে চলেছেন উত্তর কোরিয়ার বর্তমান নেতা কিম জং উন। বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে গত ১২ই ডিসেম্বর ফুফা- জ্যাং সং থায়েককে মৃত্যুদন্ড দেন উন। এরপর তিনি জ্যাং এর রক্তের সম্পর্কের প্রত্যেককে নিশ্চিহ্ন করেন। রেহাই পায়নি নিরপরাধ শিশুরাও। জ্যাংয়ের বংশের কোন চিহ্ন না রাখার জন্যই এ গনহত্যার আদেশ দেন কিম জং।
যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে জ্যাং এর বোন জ্যাং কাই-সুন ও তার স্বামী জন ইয়ং জিন (কিউবাতে উত্তর কোরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত), জ্যাং এর ভাতিজা জ্যাং ইয়ং-চোল, মালয়শিয়াতে প্রেরিত সাবেক রাষ্ট্রদূত ও তার দুই সন্তান। তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং নির্বাসন দেয়া হয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামে। জ্যাংয়ের দুই ভাইয়ের পুত্র কন্যা এবং তাদের দৌহিত্র কেউই রেহাই পায়নি। এভাবে ক্ষমতায় নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখছেন উন। এছাড়া কিম জং উনের নির্দেশে বিমান বিধ্বংসী কামানের গোলায় দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিওন ইয়ং চলের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল এ ঘটনা ঘটার অন্তত দুই সপ্তাহ পর তা জানাজানি হয়। সামরিক বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে কিম জং উন উপস্থিত থাকাকালে তিনি ঘুমিয়ে পড়ায় এবং অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা না দেওয়ার তাকে এ শাস্তি দেওয়া হয়। এদিকে কিম জং উনের আদেশে চলতি বছরে ১৫ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল এবং তারা কিমের বিভিন্ন রাষ্ট্রনীতির বিষয়ে তার সঙ্গে একমত ছিলেন না। যাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন উত্তর কোরিয়ার উপ-বনমন্ত্রী, যিনি নিখোঁজ ছিলেন। মূলত কিম জং উনের কাছে কোনো যুক্তিপ্রদর্শন বা ক্ষমাপ্রার্থনা কাজে আসে না। কোন কাজে বাধাগ্রস্ত হলে, যাদের কারণে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, তাদের তিনি মৃত্যুদন্ড দেন উন। উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নিজের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্যই এমন কান্ড করছেন কিম জং উন।
এছাড়া উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন নিজের স্বেচ্ছাচারিতাও বজায় রেখেছেন। এমনকি নিজের নামে নাম রাখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন তিনি। সে দেশে যাদের এই নাম আছে, তাদেরও তা বদলে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেবিএস টিভি ও ইউনাপের খবরে বলা হয়েছে, ২০১১ সাল থেকেই এ নির্দেশ বহাল আছে। তবে সম্প্রতি এটি জনসমক্ষে আসে। সরকারি নির্দেশে জানানো হয়েছে, কোনো নবজাতকের নাম কিম জং-উন রাখা যাবে না। যাদের এই নাম আছে, তাদের জন্মসনদ সংশোধন করতে হবে।
কিমের বাবা কিম জং-ইল ও দাদা কিম ইল-সাংয়ের নামে নাম রাখার ক্ষেত্রেও একই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে। এদিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে প্রশ্নহীন আনুগত্য তৈরি করার অংশ হিসেবে পাঠ্যবইয়ে কিম জং উনের জীবনী যুক্ত করা হচ্ছে। যার পুরোটা জুড়েই থাকছে ‘বিস্ময়বালক’ কিম জং উনের মাহাতœ্য। কীভাবে মাত্র তিন বছর বয়সে দক্ষ চালক হয়ে উঠেছিলেন, মাত্র নয় বছরে নৌ-প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন এসবেরই আখ্যান থাকবে সেই অবশ্যপাঠ্য বিষয়ে। কিছুদিন আগে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি টিভি চ্যানেলের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম এই খবর প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, উনের এই নতুন কৌশলের পিছনে একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে প্রশ্নহীন আনুগত্য তৈরি করা। শিক্ষক-শিক্ষিকারা তো বটেই, শিক্ষার্থীরাও যাতে উত্তর কোরিয়ার এই স্বৈরতন্ত্রী প্রশাসকের ব্যাপারে অনুগত থাকেন, তা নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ। উত্তর কোরিয়ার শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে, তাদের রাষ্ট্রপ্রধান রাজনীতির আঙিনায় দক্ষ তো বটেই, পাশাপাশি ছবি আঁকাতেও সমান পটু। আবার তিনি সুর¯্রষ্টাও বটে। একই সঙ্গে অকুল সমুদ্রে দক্ষ নাবিকের মতো ভেসে বেড়ানোর ক্ষমতাও তাঁর জন্মগত। নতুন বিষয়টির জন্য যে পাঠ্যবই প্রকাশ করেছে প্রশাসন, তাতে বলা হয়েছে, মাত্র নয়বছর বয়সে একটি বিদেশি ইয়ট কোম্পানির প্রধানের সঙ্গে নৌকা প্রতিযোগিতায় জিতেছিলেন উন। সব মিলিয়ে উত্তর কোরিয়ার এই শাসককে বিস্ময়বালক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ওই পাঠ্যবইয়ে। কীভাবে বিষয়টি পড়ানো হবে, তা নিয়ে চলতি শিক্ষাবর্ষে বিস্তারিত নিয়মাবলি পাঠানো হয়েছে শিক্ষকদের কাছে।
এদিকে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন মার্কিন মদদপুষ্ট প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়াকে একের পর এক হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় মার্কিন ঘাঁটি তাক করে বিধ্বংসী রকেট পর্যন্ত মোতায়েন করেছেন। দুই কোরিয়ার যৌথ শিল্প এলাকা থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মীদের। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা পারমাণবিক চুল্লি আবার চালু করার ঘোষণা দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। উনের এসব কর্মকান্ডে সারা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন দুই কোরিয়ার সমস্যা। খোদ মার্কিন কর্তৃপক্ষ রীতিমতো নড়েচড়ে উঠেছে। জোরদার করছে তাদের সামরিক শক্তি। তবে কি কিম জং-উন বাবা ও দাদার চেয়েও শক্তিমান নেতা? না, ¯্রফে খেয়ালখুশির বশে ঘটিয়ে যাচ্ছেন এসব আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা? আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সত্যিই তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও তার এশীয় মিত্রদের বিরুদ্ধে কিছু করে দেখাতে পারবেন? ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তর কোরিয়ার প্রয়াত নেতা কিম জং-ইলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় যখন তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে বড় দুই ছেলেকে ডিঙিয়ে ছোট ছেলে কিম জং-উনের নাম ঘোষণা করা হয়, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক কানাঘুষা শুরু হয়েছিল। একে তো কিম জং-উন বয়সে নেহাত তরুণ, তার ওপর তাঁর কিছু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের কথা চাউর হয়ে গিয়েছিল। শোনা গিয়েছিল, তাঁর বিদ্যার পাল্লা তেমন ভারী নয়, বুদ্ধিশুদ্ধিতে ধার নেই, রাজনীতির চেয়ে খেলাধুলায় ঝোঁক বেশি। আবার তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। এসব খবরে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, উন আর যা-ই হোন, বাবা ইলের মতো অতটা প্রভাবশালী নেতা হতে পারবেন না।
কিন্তু গত কয়েক মাসে বেশ দাপটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গন গরম করে তুলেছেন তিনি। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, প্রয়াত বাবা কিম জং-ইলের মধ্যে আক্রমণাতœক বাগাড়ম্বরের যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে, ছেলে কিম জং-উনের মধ্যেও তার ছাপ রয়েছে। একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ওয়াশিংটনকে সরাসরি হুমকি দেওয়ার দিকটিই উত্তর কোরিয়ার তরুণ নেতার নতুনত্ব। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, মৌখিকভাবে আক্রমণ ও হুমকি দেওয়া কিম পরিবারের পুরোনো ঐতিহ্য। গত ৫০ বছরে ক্ষমতায় থাকাকালে তরুণ কিমের বাবা ও দাদা একই কাজ করেছেন। তবে কিম জং-উন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের পর্যাপ্ত ধারণার অভাব রয়েছে। ওয়াশিংটন এখনো ৩০ বছর বয়সী এই নেতাকে মূল্যায়নের চেষ্টা করছে। এক মার্কিন কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘আমাদের কাছে কিম জং উন সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য নেই। কূটনৈতিক টানাপোড়েন সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর বাবার মতো কি না, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। কিমের কথাবার্তা ও সামরিক কর্মকান্ড দেখে মনে হচ্ছে, তিনি দেশের প্রভাবশালী সামরিক নেতৃত্বের চাপের মুখে আছেন। কিম জং উন ক্ষমতায় এসে বাবার মতো ‘সামরিক বাহিনীই প্রথম’ নীতি অনুসরণ করছেন।’ সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং ওন বলেছেন, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ মোকাবিলার সময় এসেছে এখন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক মহড়াকে ‘অপরিণামদর্শিতা’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়ার পরিপ্রেক্ষিতে কিম বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে কোরীয় উপদ্বীপে পারমাণবিক যুদ্ধ বাধানোর পাঁয়তারা চলছে। সিউলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এখন ‘যুদ্ধাবস্থার’ দিকে গড়াচ্ছে। যদি কোনো রকম উসকানিমূলক আচরণ করা হয়, তবে কঠোর পাল্টা জবাব দেওয়া হবে।’ মার্কিন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, হুমকি অনুযায়ী উত্তর কোরিয়ার সামরিক সমাবেশের তেমন অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। বরং তরুণ কিমের হুমকি শুনে তারা কিম জং-ইলের আমলের স্মৃতিতে ফিরে গেছেন। বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কিম জং উনের বাবাও একই কায়দায় বাগাড়ম্বর ও সামরিক কুচকাওয়াজ করতেন। এক জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, বাবার সঙ্গে ছেলের পার্থক্য কেবল ভঙ্গি ও স্বরে। এছাড়া, তরুণ কিম বিভিন্ন কর্মকান্ডে ব্যক্তিগতভাবে বেশি সম্পৃক্ত। আর তাঁর হুমকিগুলো অধিক সুনির্দিষ্ট এবং সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া।
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দেশটিকে শয়তান চক্রের অংশ বলেছিলেন। বর্তমানে উত্তর কোরিয়া উদীয়মান সামরিক শক্তির একটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো বড় সামরিক শক্তির মুখোমুখি এই দেশ। উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পারমাণবিক স্থাপনার হাতেখড়ি নেয়। পারমাণবিক শক্তিধর দেশটির দুই থেকে নয়টি পারমাণবিক বোমার কাঁচামাল আছে বলে ধারণা করা হয়। ১৯০৬ সালের অক্টোবরে শর্ট রেঞ্জ মিসাইলের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। এটি পরীক্ষা করা হয় মাটির নিচে। বিশ্বে বর্তমান সময়ে উত্তর কোরিয়া বৃহৎ সামরিক শক্তির দেশ। দেশটিতে বর্তমান সেনা সংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন। এই সংখ্যা বিশ্বে চতুর্থ। উত্তর কোরিয়ার আট শতাধিক ব্যালাস্টিক মিসাইল রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে লং রেঞ্জের যেসব মিসাইল রয়েছে তা একদিন আমেরিকা আক্রমণ করতে পারবে বলে সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এই লং রেঞ্জের মিসাইলকে স্কাড মিসাইলে উন্নীত করা হচ্ছে। স্কাড মিসাইল অনায়াসে যেকোনো দিকে ছুটতে পারে। কমিউনিস্টশাসিত উত্তর কোরিয়া ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালে দেশটিতে মিসর হয়ে স্কাড মিসাইল আসে বলে অফিসিয়ালি বলা হয়েছে। এর নাম ছিল স্কাড-বি। এই মিসাইলটির ডিজাইন তৈরি করা হয়েছিল ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইয়ুম কাপুর যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। ১৯৮৪ সালে উত্তর কোরিয়া তার নিজস্ব প্রযুক্তির মাধ্যমে স্কাড-বি মিসাইলের উন্নয়ন করে। নাম দেয়া হয় স্কাড-সি। এছাড়া একই সময়ে তৈরি করা হয় নুডং নামে মধ্যম রেঞ্জের মিসাইল। একই প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে পরে লং রেঞ্জের মিসাইল তৈরি করা হয়। নাম দেয়া হয় দ্য টায়পোডং। এর দু’টি সংস্করণ। টায়পোডং-১ ও টায়পোডং-২। টায়পোডং-১ আঘাত হানতে পারে দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার দূরত্বে। আর টায়পোডং-২ আঘাত হানতে পারে চার হাজার থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে। বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, টায়পোডং-২ সফলভাবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানতে সক্ষম। এর নতুন মডেল ১৫ হাজার দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারবে বলে তাদের ধারণা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উত্তর কোরিয়াকে বিশ্বে ‘কবরের হুমকি’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বিশ্বকে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে কোনো ছাড় না দেয়ার পক্ষে মত দিয়ে প্রয়োজনে আক্রমণাত্মক হতে পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া বারাক ওবামা উত্তর কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একদম পেটের মধ্যে আঘাত হানা যায় এমন সব অস্ত্র আবিষ্কার করছে উত্তর কোরিয়া। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের হুমকি ও নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে আপনজনদের হত্যাসহ নানান কর্মকান্ডে দেশটি সম্পর্কে দক্ষিণ কোরিয়া ও তার ঘনিষ্ট মিত্র যুক্তরাষ্ট্র টেনশনে রয়েছে সেটা বলাই যায়। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব এখনো যে শেষ হয়নি তা উত্তর কোরিয়ার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এই দ্বন্দ্ব এখন কত দূর এগিয়ে যাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।