মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বন্দিশিবির ও কারাগারে দিন কাটছে তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশির। এর মধ্যে ১২টি বন্দিশিবিরে রয়েছেন ১ হাজার ৫৯৩ জন। আর বিভিন্ন কারাগারে সাজা খাটছেন ১ হাজার ৬৩৭ জন। এঁদের বেশির ভাগই অবৈধভাবে প্রবেশ ও অবৈধভাবে অবস্থানের কারণে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সাগরপথে মানব পাচার বেড়ে যাওয়ায় বন্দিশিবির ও কারাগারগুলোতে বাংলাদেশিদের সংখ্যাও বেড়েছে। মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তারের পর ও জেলে সাজার মেয়াদ শেষে বিদেশিদের বন্দিশিবিরে রাখা হয়। গত ছয় বছরে প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশিকে সাজা খাটা শেষে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাই অবৈধভাবে কাউকে মালয়েশিয়ায় না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন।
বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র বলেছে, চলতি বছরের ৩০ জুনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১২টি বন্দিশিবিরে (ক্যাম্পে) ১ হাজার ৫৯৩ জন বাংলাদেশি আটক আছেন। এর মধ্যে সেমুনিয়া ক্যাম্পে ১৩২ জন, লেংগিং ক্যাম্পে ২৩৬, লাংগকাপে ২৫০, জুরুতে ৫৬, তানাহ মেরায় ৪৮, মাচাপ উম্বুতে ১৭৯, পেকান নানাসে ১২০, আজিলে ১২৬, কেএলআইএ সেপাং ডিপোতে ৮১, ব্লান্তিকে ১১৩, বুকিত জলিলে ২৩৪ ও পুত্রজায়ায় ১৮ জন বাংলাদেশি আটক আছেন।
এদের বেশির ভাগকেই অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের কারণে কিংবা ভিসার মেয়াদ শেষে অবৈধভাবে অবস্থানের কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন, ১৯৫৯-এর ধারা ৬(১) সি/১৫ (১) সি এবং পাসপোর্ট আইন, ১৯৬৬-এর ১২(১) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
হাইকমিশন সূত্র বলেছে, মালয়েশিয়ার ক্লুয়াং, সুগাই বলোহ, পেংকেলান চেপা, আলোস্তার, তাইপিং, মারাং, তাপাহ, সেরেমবাম, কাজাং, পেনর, পেনাং, বেনটং, মিরি, কেমুনটিং, পোকোসেনা ও সিবু কারাগারে ১ হাজার ৬৩৭ জন বাংলাদেশি বিভিন্ন মেয়াদে সাজা খাটছেন। এঁদের বেশির ভাগই অভিবাসন আইন ও পাসপোর্ট আইন ভাঙার অপরাধে সাজা ভোগ করছেন। এ ছাড়া মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জেলিবু অ্যান্টি ড্রাগ কারাগারে আছেন কয়েকজন বাংলাদেশি। খুনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়া চারজনও কারাগারে রয়েছেন।
বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রথম সচিব শাহিদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়ায় বিদেশি কাউকে গ্রেপ্তারের পরপরই ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারের রায় হওয়ার আগ পর্যন্ত¯তাঁকে ক্যাম্পে থাকতে হয়। রায়ের পর তাঁকে জেলে গিয়ে সাজা ভোগ করতে হয়। সাজা শেষে দেশে ফেরত যাওয়ার আগ পর্যন্তও তাঁকে ক্যাম্পে থাকতে হয়। ফলে সব সময়ই ক্যাম্পগুলোতে কয়েক হাজার লোক বন্দী থাকেন।
মালয়েশিয়ায় অভিবাসন আইন ও পাসপোর্ট আইন ভাঙলে ২ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে বিচারক যেকোনো মেয়াদে কারাদণ্ডও দিতে পারেন।
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশের উপসহকারী পরিচালক জোসামি মাস্তান বলেন, বিভিন্ন কারাগার ও ক্যাম্পে যাঁরা বন্দী আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ কিংবা অবৈধভাবে থাকার কারণে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এঁদেরই একজন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার নজরুল ইসলাম। তাঁর কয়েকজন স্বজন কুয়ালালামপুরে প্রথম আলোকে বলেন, সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে প্রফেশনাল ভিসায় এ বছরের ৩১ জানুয়ারি নজরুল মালয়েশিয়ায় আসেন। জহুর বারুতে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। কিন্তু যে দালালের মাধ্যমে তিনি এসেছিলেন, সেই দালাল পাসপোর্টে কাজের অনুমতি বা পারমিট লাগায়নি। এ কারণে ২২ মে অবৈধ হিসেবে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তিনি কুয়ালালামপুরের একটি ক্যাম্পে বন্দী আছেন।
দুবার দুটি পাসপোর্টে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করায় কুমিল্লার মো. আলম মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সাগরপথে আসা অনেকে গ্রেপ্তার হচ্ছেন।
হাইকমিশন সূত্র বলেছে, সাজা শেষ হওয়া কাউকে আদালত দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিলে হাইকমিশন ট্রাভেল পারমিট দিয়ে তাঁকে দেশে পাঠায়। গত বছর এভাবে আট হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরেই ১ হাজার ৫৭৩ জন ফিরেছেন। চলতি বছরের ছয় মাসে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। এর আগে ২০১৩ সালে প্রায় দুই হাজার, ২০১২ সালে প্রায় দেড় হাজার, ২০১১ সালে প্রায় আট হাজার, ২০১০ সালে প্রায় ১০ হাজার এবং ২০০৯ সালে ১৬ হাজার বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন।
বন্দিশিবির ও কারাগারে সাজা খেটে দেশে ফেরা বাংলাদেশিদের অনেকে অভিযোগ করেন, ক্যাম্পগুলোতে প্রায়ই বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতন করা হয়। অনেক সময় ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না। আবার দীর্ঘদিন জেলে বা ক্যাম্পে থাকলেও হাইকমিশন তাঁদের দেশে ফেরাতে উদ্যোগ নেয় না। কেউ কেউ ক্যাম্পেও মারা যান। এর মধ্যে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় গত ১১ মে লংকাবিতে উদ্ধার হওয়া ৭১৬ জনের একজন আবদুর রশিদ ৫ জুন ব্লান্তিক ক্যাম্পে মারা গেছেন। আরও দুটি ক্যাম্পে দুজন শ্রমিক মারা গেছেন। তাঁদের লাশ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর সায়েদুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন ক্যাম্প ও কারাগারে থাকা বাংলাদেশিদের মুক্তির জন্য হাইকমিশনের কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে ক্যাম্প সফর করেন এবং বন্দী নাগরিকদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে রাখেন। প্রয়োজন অনুযায়ী ট্রাভেল পারমিট দিয়ে তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তাই অবৈধভাবে কারও মালয়েশিয়া আসা ঠিক নয়।(প্রথম আলো)