রেজওয়ান চিন্তা করলেন, এ জলাধারকেই তাঁর গ্রামের উন্নয়নে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে৷ সে ভাবনা থেকেই তিনি নৌকার মধ্যে স্কুলের নকশা করলেন৷ স্থাপন করলেন ‘ভাসমান স্কুল’৷ ২০০২ সালে এই স্কুলের যাত্রা শুরু৷ আর সেই যাত্রায় স্কলারশিপের মাত্র ৫০০ মার্কিন ডলার ও একটি ল্যাপটপ নিয়েই তিনি কাজ শুরু করেন৷ প্রথম এক বছর বিভিন্ন স্থানে ইমেইল করতে থাকেন সাহায্যের জন্য। পেয়ে যান ৫,০০০ মার্কিন ডলার অনুদান৷ তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে৷
স্কুলের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল৷ এই বিদ্যুতে সন্ধ্যার পরও স্কুলের কার্যক্রম চালানো যায়, গ্রামেও আলো দেয়া যায়৷ সাধারণ বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের মতোই নৌকার ভেতরে শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার সবকিছুই আছে৷ বরং এ নৌকা স্কুল সেখানকার ভূমিতে স্থাপন করা অন্যান্য স্কুলের চেয়ে আরও বেশি আধুনিক৷ এ স্কুল কম্পিউটারসহ শিক্ষায় ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক অনেক ডিভাইস দ্বারা সুসজ্জিত৷ এক যুগে মাঝেই বর্তমানে সিন্ধুলাইয়ের ১১১টি নৌকা রয়েছে এবং প্রায় ১ লাখ পরিবারের শিশুরা এটি থেকে উপকৃত হচ্ছে।
আর এই স্কুল থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে অনেক সময়ই বাবা-মা মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠাতে চায়না। কিন্তু ঘরের কাছে নৌকার মধ্যে স্কুলে মেয়েদেরকে পাঠাতে আপত্তি হয়না কারও।
স্কুলগুলোর দৈর্ঘ্য ৫৫ ফুট ও প্রস্থ ১১ ফুট৷ একসঙ্গে ৩০ জন শিশু পাঠ নিতে পারে একটি স্কুলে৷ শিশুদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকরাও কম্পিউটারসহ তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন৷
অভিনব এই পদ্ধতি উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই ১৪টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে পেয়েছেন সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ান৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মুখে থাকা কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন্স, ভিয়েতনমি ও জাম্বিয়াসহ আরও অনেক দেশে চালু হয়েছে এই ভাসমান স্কুল৷
রেজওয়ান জানান, পুরস্কারের টাকায় নৌকা স্কুল, সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে গ্রাম আলোকিত করার প্রকল্পসহ স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার কাজ করছেন৷
অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবেলায় মানুষের সংগ্রামের অসাধারণ চিত্রকল্প হিসেবে আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রমে এ ভাসমান স্কুল প্রকল্প সম্পর্কে পড়ানো হচ্ছে ৷ এ ব্যাপারে মোহাম্মদ রেজওয়ান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ভবিষ্যতে তলিয়ে যেতে পারে অনেক জনপদ৷ এছাড়া বাংলাদেশসহ বন্যাকবলিত বিভিন্ন দেশের জলমগ্ন অঞ্চলে জীবনযু্দ্ধ একটি বড় চ্যালেঞ্জ৷ ভাসমান স্কুলকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে৷ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, স্লোভানিয়ার মত উন্নত দেশের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমে যুক্ত হয়েছে এই স্কুল৷
তবে শুধু ভাসমান স্কুলেই থেমে থাকেনি সংস্থাটির কার্যক্রম। এখন ভাসমান স্বাস্থ্য ক্লিনিক ও কৃষি বিষয়ক ট্রেনিং সেন্টারের কাজও করছে এই নৌকাগুলো।
এই ভাসমান স্কুলের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আরো কাজ করার ইচ্ছা রেজওয়ানের। বন্যা কবলিত এলাকায় অনেক সময় ফসলের ক্ষতি হয়। তাই তিনি এখন ‘ভাসমান খামার’ তৈরির পরিকল্পনা করছেন। যেখানে থাকতে পারে সবজি বাগান, মুরগির খামার কিংবা মৎস খামার।সঙ্গে ভাসমান স্কুলকে ভাসমান বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত উন্নীত করার স্বপ্নও তাঁর রয়েছে৷ তবে এর জন্য আরও বেশি তহবিল প্রয়োজন৷ এ তহবিলসংগ্রহ অনেক কঠিন৷ সেই কঠিন প্রচেষ্টাই এখন চালিয়ে যাচ্ছেন মোহাম্মদ রেজওয়ান৷
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা গ্রামবাসীকের এই ভাসমান স্কুলের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে হয়তো ভাসমান খামার তৈরিও সম্ভব হবে।’
তার ভাসমান এই স্কুল নিয়ে বিখ্যাত তথ্যচিত্র নির্মাতা গ্লেন বেকারে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘ইজি লাইক ওয়াটার’ নামের এই চলচ্চিত্রে নৌকা স্কুলের পাশাপাশি সিধুলাই গ্রাম আর চলনবিলের দৃশ্য দেখানো হয়েছে৷ তথ্যচিত্রটি এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮০০ বার প্রদর্শিত হয়েছে৷
সূত্র: ম্যাশাবল অনলাইন