সবাই মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়েই কথা বলতে চাইবেন। আবারও আলোটা কেড়ে নিলেন এই বাঁ-হাতি বিস্ময়। সেই আলো কিছুটা ঠিকরে পড়ছে জুবায়ের হোসেনের ওপরও। চট্টগ্রাম টেস্টের স্কোরকার্ড, পরিসংখ্যান বলবে, টেস্টের এক নম্বর দল প্রথম ইনিংসে অসহায় আত্মসমর্পণ করল মুস্তাফিজ আর জুবায়েরের কাছে। এমনকি উঠে আসবে সাকিব, তাইজুল কিংবা মাহমুদউল্লাহর নামও। ৩৪ রান দিয়ে উইকেটশূন্য এক বোলারকে নিয়ে কেইবা শব্দ খরচ করতে চায়! অথচ আজকের দিনের আসল নায়ক হতে পারতেন তিনিই। আজকের দিনে বাংলাদেশের বোলারদের সাফল্যের ভিত্তিটা তাঁর হাতেই গড়া। ‘আনসাং হিরো’র নাম মোহাম্মদ শহীদ।
ঘরোয়া ক্রিকেটে সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েই জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন। কিন্তু চতুর্থ টেস্টে এসেও নামের পাশে মাত্র ৫টি উইকেট, ৫৫-এর ওপরে গড়। কেউ কেউ প্রশ্নটা করবেনই—শহীদ কেন দলে? শহীদ নিজেও জানেন, কাঠের চামচ মুখে দিয়েই বাংলাদেশের পেসারদের জন্ম হয়। এখানে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করতে হবে নিজের জায়গার জন্য। শহীদ লড়লেনও। নিজের নামকে সার্থক করে তোলার মতো লড়াই। সেই লড়াইয়ের ছবি লেখা থাকল না পরিসংখ্যানে।
ক্রিকইনফোর এক পাঠক মন্তব্য করেই বসলেন, ‘শহীদই কি টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগা বোলার?’
শহীদ আসলে লড়ে যাচ্ছেন শুরু থেকেই। দানবীয় পেস নেই। সুইংয়ের অস্ত্রটাতেও তেমন ধার নেই। আসল শক্তি একই জায়গায় ক্রমাগত বল করে যাওয়ার বিরামহীন ধৈর্য। সেই অস্ত্রটাকেই সম্বল করে এগোলেন আজও। দ্বিতীয় স্পেলের প্রথম ওভারের চতুর্থ বল থেকে শুরু। এর পর টানা ৫১টি বলে কোনো রান দিলেন না! এর মধ্যে করলেন টানা সাত ওভার মেডেন! ১২ ওভার শেষে দেখা গেল, মেডেন আটটিতেই!
শহীদের এই চেপে ধরা বোলিংয়ের সুফলই পেয়েছেন মুস্তাফিজ-জুবায়েররা। সে কথা দিনের নায়ক মুস্তাফিজ স্বীকারও করে গেছেন। কিন্তু বোলারদের ক্ষুধা মেডেনে ভরে না, উইকেট চাই। দিন শেষে একটা উইকেটও তাঁর নামের পাশে নেই, এর সান্ত্বনা কোথা থেকে খুঁজবেন শহীদ? স্লিপে ফিল্যান্ডারের সহজতম ক্যাচটা ইমরুল ছেড়ে না দিলেও অন্তত একটা উইকেট থাকতে পারত। ভাগ্যও বেশ কবার বঞ্চিত করেছে তাঁকে। শুধু এই টেস্টে নয়, ভাগ্যকে শহীদ পাশে পাননি পাকিস্তান-ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের আগের তিন টেস্টেও।
দিন শেষে গোটা দিনে বল করেছেন ১৭ ওভার। সব মিলিয়ে ৯টি মেডেন। ওভারপ্রতি মাত্র ২ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ব্যাটিং শক্তির বিপক্ষে এই পরিসংখ্যান কম কীসে! তবুও হোটেলে ফেরার পথে টিম বাসে ইমরুল হয়তো শহীদের কাছে গিয়ে ছোট্ট করে বলেছেন, ‘স্যরি!’
উইকেট না পেলেও আজ দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কিন্তু করেছেন শহীদই। সেটা হচ্ছে চাপ তৈরি করা। নিজের তৃতীয় স্পেলে বল করতে এসে পরপর ছয়টি মেডেন। এর আগ পর্যন্ত কিন্তু খুব সহজেই খেলছিলেন ডিন এলগার ও ফ্যাফ ডু প্লেসি। ওই ছয় মেডেনের পর পরই ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল সবকিছু। চাপটা তৈরি হলো প্রোটিয়াদের ওপর। সেই চাপের ধারাবাহিকতাতেই তিন বলের ব্যবধানে ভাঙল ৭৮ রানের জুটি। এলগার আর ডু প্লেসি দুজনই ফিরে এলেন তিন বলের ব্যবধানে। ফেরালেন তাইজুল আর সাকিব। ১৩৬ রানের মধ্যে জোড়া আঘাতের ধাক্কাটা এতটাই ভয়ংকর ছিল, তৃতীয় সেশন আমলা, ডুমিনি আর ডি ককদের সামনে আরও ‘খুনে’ হয়ে উঠলেন মুস্তাফিজুর।
শহীদ যে আসলেই কতটা দুর্ভাগা, সেটা পরিসংখ্যানও বলবে। এ বছর পাকিস্তান সিরিজে অভিষেকের পর থেকে শহীদ খেলছেন চার নম্বর টেস্ট। এই ৪ টেস্টে বাংলাদেশের বোলাররা মোট ৫৫০ ওভার বল করে ৬২ ওভার মেডেন করেছে। এর মধ্যে শহীদই ৯৯ ওভার বল করে একাই করেছেন ২৯টি মেডেন ওভার। বাকি সব বোলাররা (সাকিব, তাইজুল, জুবায়ের, রুবেল, রিয়াদ, সৌম্যরা) মিলে ৪৫১ ওভার করে মাত্র ৩৩ মেডেন নিয়েছেন।
পরিশ্রম নাকি ভাগ্য ফেরায়। ভাব-সম্প্রসারণেও লেখা হয়—পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। দেখা যাক, সৌভাগ্য শহীদের দিকে মুখ তুলে তাকাতে কত সময় নেয়। (প্রথম আলো)