পাচারের পর ভারতের পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল ওদের। কেউ এক বছর আবার কেউ কেউ দুই/তিন বছর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মৃত্যুপুরী থেকে ফিরে আসবে পিতা-মাতার বুকে সেটি কল্পনায়ও ছিল না ওদের। এমনই ৪৭ জনকে ফিরিয়ে দেয়া হলো পিতা-মাতার বুকে। পিতা-মাতা ও সন্তানের অশ্রুসিক্ত মিলনমেলায় তারা কাঁদলেন এবং কাঁদালেন সবাইকে।
ফিরতে পেরে যেমন সন্তানরা কাঁদছিলেন, তেমনি সন্তানকে বুকে ফিরে পেয়ে পিতা-মাতাও কেঁদেছেন। আর অতিথিরাও সমব্যথী হয়ে আবেগাপ্লুত বক্তব্যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন আলোর পথের যাত্রীদের। অন্ধকার জীবন থেকে আলোকিত পৃথিবীর পথে চলার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন অতিথিরা।
সোমবার দুপুরে রাইটস যশোর কার্যালয়ে শতাধিক নারী-পুরুষের ভিড়। খেটে খাওয়া মানুষগুলো দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন। চোখে মুখে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আকুতি। একটি ঘরের ভিতর চলছে তরুণীদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল হাসান। সেখানে তরুণী ও তাদের স্বজনরা বসে আছেন।
অনুষ্ঠানে ফেলে আসা দুঃসহ জীবন সংগ্রামের কথা বললেন বগুড়ার মেয়ে চৈতী। তিনি জানান, আজ মায়ের বুকে ফিরে আসবো স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। ফেরার জন্য কত সংগ্রাম করেছি। অবশেষে ফিরে আসতে পেরেছি। জীবনের ফেলে আসা দুঃসহ যন্ত্রণার দিনগুলো আর মনে করতে চাই না। ভুলে যেতে চাই অতীতের ঘটনা। নতুন করে জীবন শুরু করার প্রত্যয়ী তার।
চৈতীর মত পাচারের শিকার হয়ে দুর্বিসহ যন্ত্রণা ভোগ শেষে ৭৪ জন তরুণী গত ২ জুলাই রাতে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। প্রত্যেকের জীবনই ট্র্যাজেডি পূর্ণ। পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য এদের মধ্যে ৪৭ জনকে রাইটস যশোর নামের একটি বেসরকারি সংগঠন গ্রহণ করেছিল। দুই দিনের জীবন দক্ষতার প্রশিক্ষণ শেষে সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ সোহেল হাসান, রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিকের উপস্থিতিতে পাচারের শিকার ওই তরুণীদের অভিভাবকদের হাতে তুলে দেয়া হয়।
বুকে ফিরে আসা তরুণীরা হলেন, আসমা আক্তার, রিনা খাতুন, স্মৃতি, রিনা খাতুন, সাজেদা, রুনা, মোরশেদা, ছালমা, নিলা, সাবিনা, ছালমা, আশা, পিংকি, সুফিয়া, ঝুমা, কাওছারি, সাবানা, নিলুফা, জোহরা, রিমা, রাবেয়া, রত্মা, জবেদা, লাকী, সুমি, সেলিনা, পারভীন, সোনিয়া, সাবিনা, তাসলিমা, নারগিস, জাকিয়া, সাথী, সালমা, রুমি, চৈতি, মুন্নী, পারভীন, আদুরী, পান্না, রেহেনা, শিল্পী, সাথী, লিমা, নিশি, ফিরোজা, শাহিনুর।
তরুণীদের অভিভাবকের কাছে তুলে দেয়ার সময় সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পিতা-মাতা সন্তানকে ফিরে পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তারা। সন্তানরাও পিতা-মাতা আত্মীয় স্বজনদের বুকে ফিরে আসতে পেরে আনন্দে কেঁদে ফেলেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে চৈতী বলেন, মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করবেন না। কোনো সিদ্ধান্ত মেয়ের ওপর চাপিয়ে দিবেন না। জীবনের ছোট একটু ভুলের জন্য জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। অনেকে জীবনে এর চেয়ে অনেক বড় ভুল করে। চৈতীর আবেগঘন বক্তব্যে উপস্থিত অতিথি ও অভিভাবকরাও অশ্রুসিক্ত হন।
এক অভিভাবক মা তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, ১৩ বছর বয়সে মা হয়েছিলাম। মেয়েটা যখন ছোট তখন ওর আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পরে আবার ওর বাবা ফিরে এসে আমাদের গ্রহণ করেছে। আমার চার সন্তান। অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছি। মেয়েকে ফিরে পাওয়ার জন্য তিন বছর ধরে চেষ্টা করেছি। এক পর্যায়ে আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। মেয়েকে কাছে পেয়ে এখন তার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।
ফরিদপুর থেকে আসা আরেকজন অভিভাবক জানান, মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন যশোরে। জামাই একবার মেয়েকে ভারতে নিয়ে গিয়েছিল। পরে আবার ভারতে নিয়ে বিক্রি করে দিয়ে এসেছে। দুই বছর পর মেয়েকে কাছে পেয়েছেন তিনি।
রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, ভারত থেকে ফেরত আনার পর আনুষ্ঠানিকভাকে তাদের অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ অনুষ্ঠান মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। যাদের পরিবারে ফিরিয়ে দেয়া হলো তাদের সব সময় মনিটরিং করা হবে। সারভাইভারদের নিয়ে সারাদেশে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে বলেও জানান তিনি।