বিশ্বে তুলনামূলক সবচেয়ে বেশি বছর বাঁচে জাপানিরা। সর্বোচ্চ গড় আয়ুর অধিকারী হচ্ছে জাপান। এ দেশের প্রায় ১৩ কোটি মানুষের এক চতুর্থাংশের বয়স ৬৫ বা তার চেয়ে বেশি। ৪০ হাজারের বেশি জাপানির বয়স ৯০ পেরিয়ে গেছে।
সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সের পুরুষ জাপানের সাকারি মমই ১১২ বছর বয়সে মারা গেছেন। প্রাক্তন স্কুল অধ্যক্ষ মমইর জন্ম ফুকুশিমায়। গত ৬ জুলাই টোকিওর সাইতামাতে কিডনি সমস্যায় মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর পর বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বয়সের পুরুষ হচ্ছেন জাপানেরই ইয়াসুতারো কইদে। নাগোয়ায় জন্ম নেওয়া কইদের বয়সও ১১২ বছর। মমইর চেয়ে মাত্র এক মাসের ছোট তিনি।
তবে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বয়সের মানুষ হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের সুসানা মুশাট জোনস্। ১১৬ বছরের এই নারী বসবাস করেন নিউইয়র্কে। ১৮৯৯ সালের ৬ জুলাই জন্ম তার।
সে যাই হোক দেখা যাচ্ছে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বেশি বয়সের মানুষের বসবাস জাপানে। এ দেশের নারীদের গড়আয়ু প্রায় ৮৭ বছর এবং পুরুষের গড় আয়ু প্রায় ৮০ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী জাপানের লোকেরা ৭৫ বছর পর্যন্ত কোন ধরনের দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই বেঁচে থাকেন।
বিজ্ঞানীরা এই দীর্ঘায়ুর কারণ হিসেবে জাপানিদের খাদ্যাভ্যাসের কথা বলছেন। অনেক জাপানি আছেন যারা সারা জীবন সুশি ও শাকসবজি খেয়েই কাটিয়ে দেন। এছাডা আধুনিক জাপানিদের প্রচণ্ড কাজের চাপের মাঝেও স্বস্তি এনে দেয় তাদের উচ্চমানের ও কম ক্যালরিযুক্ত খাবার। মাছ আর শাকসবজি দিয়ে তৈরি তাদের অসাধারণ খাবারগুলো তাদের জীবনের দৈর্ঘ্য অনেক বাড়িয়ে দেয়।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, জাপানিদের প্রচলিত এ খাবারগুলোতে পেটের ক্যান্সার ও নানা জটিলতার ঝুঁকি কম থাকে। এসব খাবারে থাকে সামুদ্রিক উদ্ভিদ, শামুক ও অক্টোপাস।
তবে শুধু খাবারই তাদের দীর্ঘ জীবনের একমাত্র কারণ নয়। জাপানিদের দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকতে সহায়তা করে বৃদ্ধদের মানসিক চাপ কম থাকা। দেখা গেছে জাপানি বুড়ো-বুড়িরা তাদের সন্তানদের কল্যাণে বৃদ্ধ বয়সে মানসিক শান্তিতে থাকেন। তাদের সাধারণত আয়-ব্যয়, বিভিন্ন বিল ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। জাপানিরা ঐতিহ্যগতভাবেই বয়স্কদের যথেষ্ট যত্ন নেয়। আর বয়স্করাও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতে অভ্যস্ত।
জিনগত কারণেও জাপানিরা বেশি আয়ু পেয়ে থাকেন বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। দৈহিক গড়নে ছোট অর্থাৎ বেঁটে মানুষ সমবয়সী লম্বা মানুষের চেয়ে বেশি দিন বাঁচে। এ বিষয়ে কুয়াকিনি হনলুলু হার্ট প্রোগ্রাম (এইচএইচপি) এবং কুয়াকিনি হনলুলু-এশিয়া এজিং স্টাডির উদ্যোগে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। মার্কিন গবেষকরা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি থেকে খাটোদের এক দলে এবং ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি থেকে ৬ ফুট লম্বাদের আরেক দলে ভাগ করে পর্যবেক্ষণে রাখেন।
প্লস ওয়ান সাময়িকীতে প্রকাশিত নিবন্ধে গবেষকরা জানান, মানুষ বেঁটে হয় জিনগত কারণে। আর বেঁটে মানুষের দেহে রয়েছে দীর্ঘায়ুর জিন ফক্স জিরো থ্রি। এ জিন কৈশোরেই মানুষকে লম্বা হতে বাধা দেয় এবং একই সঙ্গে আয়ুকে দীর্ঘ করে। তাছাড়া বেঁটে মানুষের রক্তের ইনসুলিন লেভেলও কম থাকে এবং ক্যান্সারের মতো রোগও কম হয়। সব মিলিয়ে বেঁটে মানুষ বাঁচে দীর্ঘদিন।
গবেষকরা বলছেন, বেশি লম্বায় কম আয়ু আর কম লম্বা অর্থাৎ বেঁটেদের আয়ু বেশি হয়। যেমন জাপানের মানুষ কিছুটা বেঁটে বলেই তাদের আয়ু অনেক বেশি। গবেষক দলের অন্যতম হাওয়াই ইউনিভার্সিটির জন এ বার্নস স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক ব্রাডলি উইলকক্স বলেন, আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি, বেঁটে দলের লোকজন আয়ু বেশি পেয়েছে। আর বেঁটেদের বেশি আয়ুর সঙ্গে জড়িত এক ধরনের জিন।
এ ছাড়া জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বা বার্ধক্য সংক্রান্ত অসুখ-বিসুখের চিকিৎসার ক্ষেত্রে জাপান বেশ উন্নতি করেছে। বিশেষ করে ক্যান্সার, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রভুত উন্নতি হয়েছে। জাপানি খাবারে ঐতিহ্যগতভাবে কম চর্বি থাকে। তবে জাপানিদের জীবনযাত্রার কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। বৃদ্ধ বয়সে তারা বেশিরভাগ সময় একাকিত্বের মধ্যে দিন কাটান। তরুণরা সাধারণত বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখাশোনা করে। কিন্তু জাপানে আজকাল একান্নবর্তী পরিবারের সংখ্যা কমে আসছে। ফলে বেশি বয়শের মানুষগুলোকে একাকী দিন কাটাতে হচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, সুন্দর এ পৃথিবীতে মানুষ যদি তার লক্ষ্য ঠিক করতে পারে, তাহলে সে আরো কয়েক বছর বেশি বাঁচবে । সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীন মানুষের তুলনায় জীবনে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে এমন মানুষ দীর্ঘায়ু হয়। গবেষক দলের প্রধান কানাডার কার্লেটন ইউনিভার্সিটির ডক্টর প্যাট্রিক হিল বলেন, জীবনে নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া ও আকর্ষণীয় উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থেই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা সম্ভব।