Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
jahidul
নরসিংদীর বাগদী এলাকায় জাহিদুল খন্দকারের সাথে কথা হয় যেদিন তার পাঁচ দিন আগে তিনি ফিরেছেন

জাহিদুল ফিরেছেন, দুঃস্বপ্ন আর ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে

জাহিদুল খন্দকারের বাড়ি নরসিংদীর বাগদি এলাকায়। মালয়েশিয়ায় জেল খেটে দেশে ফিরেছেন তিনি মাত্র ৫ দিন আগে। মাস ছয়েক নিরুদ্দেশ থাকার পর গতমাসে হঠাৎ মালয়েশিয়ার কারাগার থেকে ফোন পায় জাহিদুলের পরিবার। জাহিদুল বলছিলেন, বাড়ি ছেড়ে কিভাবে গিয়ে পৌঁছালেন পাচারকারীদের জাহাজে।

chardike-ad

“প্রথমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গেছি। এরপর দালাল রিসিভ করেছে। তিন ঘণ্টা শহরে ঘুরায়। এরপর গাড়িতে তুলে কক্সবাজার নিয়ে যায়। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশাতে করে মহেশখালীতে। আমার এলাকা থেকে ৪ থেকে ৫ জনসহ অন্যান্য এলাকার লোকজন ছিল। সবাই বাংলাদেশি”।

জাহিদুলের সাথে কথা হচ্ছিল তাদের বসত ঘরের সামনে পেতে দেওয়া প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে।

চরম নির্যাতন, খাবার না পাওয়া আর দুঃশ্চিন্তার ভারে ভীষণ ক্লান্ত । জাহিদুল বলছিলেন, তাদেরকে মায়ানমার জল সীমান্তে জাহাজে ১৫ দিন রাখা হয়। এরপর সাড়ে চারশোর মত লোক ওঠার পর জাহাজ ছাড়ে।

“আমাদের বলা হয়েছিল শিপে অনেক লোক ছিল। গিয়ে দেখলাম ৪০ জনের মত লোক। ওরা বলল সাড়ে ৪শ লোক হলে তবে শিপ ছাড়বে। এভাবে আমাদের ১৫ দিন রাখার পর শিপ ছাড়ল। যাত্রাপথে যারা অসুস্থ হয়ে পড়ে তাদের পেট কেটে সাগরে ফেলে দেয়।”

জাহিদুল বলছেন, ভাল রোজগারের স্বপ্নে লোভে পড়ে চলে গিয়েছিলেন অজানা পথে
জাহিদুল বলছেন, ভাল রোজগারের স্বপ্নে লোভে পড়ে চলে গিয়েছিলেন অজানা পথে

“লোভে পড়ে চলে গেছিলাম”

৮/৯ দিন ধরে সাগরে ভেসে ভেসে থাইল্যান্ডে পৌঁছান। এরপর থাইল্যান্ড সীমান্ত পুলিশের সহায়তায় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে মালয়েশিয়ায় পৌঁছান। না খেয়ে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বদলে পিটুনি খেয়েছেন যখন তখন। সবশেষে মালয়েশিয়ান পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জায়গা হয় কারাগারে। যাত্রাপথে বহু সহযাত্রীকে দেখেছেন মৃত্যুমুখে ঢলে পড়তে। জাহিদুলকে ফিরিয়ে আনতে দুই দফায় দালালকে দুই লাখ টাকা দিতে হয়েছে তার পরিবারকে।

এত ভয়ঙ্কর পথ কেন বেছে নিয়েছিলেন জাহিদুল?

পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করা জাহিদুল বলছিলেন, “আমার যা লেখাপড়া তাতে ভালো চাকরি জুটবে না। ৪/৫ হাজার টাকার বেশি বেতনও পাবো না। সেজন্য ভাবতাম মালয়েশিয়া যেতে পারলে মাসে ৫০ হাজার টাকা পেলে পরিবারকে সাহায্য করতে পারতাম। লোভে পড়ে চলে গিয়েছিলাম।”

ভিনদেশে কারা ভোগ করে অবশেষে জাহিদুল বেঁচে ফিরতে পারলেও এখনও অনেকের খোঁজ নেই বলে জানাচ্ছেন সেসব পরিবারের সদস্যরা। সম্প্রতি সমুদ্রে আটকের পর মায়ানমার থেকে ফেরত পাঠানো দেড়শো জন বাংলাদেশীর মধ্যে ৫৬ জনই নরসিংদী জেলার। এছাড়া পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ সহ আরও ১৭টি জেলার মানুষ আছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন কিশোরও রয়েছে।

মোবাইল ফোনে ভাইয়ের ছবি দেখিয়ে শাহিনুর আক্তার বলেন, টাকা দিলেও এখন আর খোঁজ নেই ভাইয়ের
মোবাইল ফোনে ভাইয়ের ছবি দেখিয়ে শাহিনুর আক্তার বলেন, টাকা দিলেও এখন আর খোঁজ নেই ভাইয়ের

বৈধভাবে যেতে পাসপোর্ট করা হয়েছিল নিখোঁজ আরমান হোসেনের

নরসিংদীর যেসব এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ পাচারের শিকার হয়েছেন বলে স্থানীয় লোকজন জানাচ্ছেন তার একটি রায়পুরা। রায়পুরার আরমান হোসেনও মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্য কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছাড়েন ফেব্রুয়ারি মাসে। তার বোন শাহিনুর আক্তার মোবাইল ফোনে ভাইয়ের ছবি দেখিয়ে বলছিলেন, দেড় মাস পর থাইল্যান্ড থেকে ফোন দিয়ে তার ভাই জানান, রায়পুরার এক দালালকে টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলা হবে।

এরপর দুই লাখ টাকা দেওয়া হলেও আরমানের বর্তমান হাল কি জানে না তার পরিবার। অথচ তাকে বৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য পাসপোর্টও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু অবৈধ পথে বিদেশে গিয়ে এলাকার কেউ কেউ টাকা-পয়সা পাঠাচ্ছে দেখে আরও অনেকের মত অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করা আরমানও সমুদ্রপথে যেতে উৎসাহী হয়েছিল বলে জানান শাহীনুর আক্তার।

“বৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠাতে চেয়েছিলাম। সেজন্য ভাইয়ের পাসপোর্ট করেছিলাম। কিন্তু প্রতিবেশী ১০/১২ জন এভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়ে বাড়িতে টাকা পয়সা পাঠাচ্ছে দেখে, দালালদের পাল্লায় পড়ে আমার ভাইও চলে গেছে।”

অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টায় টেকনাফে আটক বাংলাদেশীরা( ফাইল ছবি)
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টায় টেকনাফে আটক বাংলাদেশীরা( ফাইল ছবি)

দ্রুত টাকা রোজগারের মরীয়া চেষ্টা?

সুবজে ঘেরা এই মফস্বল শহরটিতে কৃষিখাতে এবং বস্ত্র শিল্পের শ্রমিক হিসেবে কাজের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তারপরও কেন এখানকার তরুণ সমাজ অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার পথ বেছে নিচ্ছেন?

স্থানীয় একজন সাংবাদিক এবং নরসিংদী প্রেসক্লাবের সভাপতি হাবিবুর রহমান বলছিলেন, বিদেশে গিয়ে দ্রুত টাকা রোজগারের এই মরীয়া চেষ্টাই তাদের বাড়ি ছাড়ার মূল কারণ।

“নরসিংদী শিল্প প্রধান একটি এলাকা হলেও অনেকেই দেখছে আশেপাশের অনেকে বিদেশে গিয়ে টাকা-পয়সা রোজগার করছে। ফলে অন্যান্য শ্রমিকদের মনে এই বিষয়টি প্রভাব ফেলছে। রায়পুরা, সদর, শিবপুরে এরকম ঘটনা আমরা দেখেছি। আর দালালরা এখন টিনএজারদের বেশি টার্গেট করছে। কারণ তাদের বোঝানো সহজ”।

সাংবাদিক হাবিবুর রহমান বলেন, টাকা ছাড়া বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আছে, এটা জেনেই গত দুই -তিন বছরে সমুদ্রপথে যাওয়ার হিড়িক বেড়ে যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

“যখন তারা জানতে পারলো বিদেশে গেলে টাকা লাগে না। হঠাৎ করে বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে অবৈধ পথে বিদেশে যাচ্ছে এরা। ২০১৩ থেকে এটা বেড়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৫ তে সেটা বেশি বেড়ে যায়”।

ভাগ্য বদলানোর আশায় আরমান হোসেনের মত অল্পবয়সীরা পড়ছে দালালচক্রের খপ্পড়ে
ভাগ্য বদলানোর আশায় আরমান হোসেনের মত অল্পবয়সীরা পড়ছে দালালচক্রের খপ্পড়ে

 ভাগ্য বদলানোর আশা

অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফ্যুইজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসোর্স ইউনিট বা রামরু। সংগঠনটির বক্তব্য এ ব্যাপারে একেবারেই ভিন্ন।

রামরুর চেয়ারপার্সন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, “ সমাজে একবারে যারা দরিদ্র, ভূমিহীন তারাই এই পথটি বেছে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বেড়াতে গিয়ে পাচারকারীদের কবলে পড়েছেন। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার যারা তারাও মরীয়া হচ্ছেন। এই পথে যারা যাচ্ছেন তাদের অন্য কোনোভাবে মাইগ্রেশনের সুযোগ নেই।”

sahinur-begum
শাহীনুর বেগমের কিশোর ছেলেকে চারবার বিক্রী করা হয়েছে

লোভনীয় টার্গেট টিন এজাররা

নরসিংদী জেলার এমন অনেক কিশোর আছে যারা এখনো স্কুলের গণ্ডিই পেরোয়নি, তারাও সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া রওনা হয়ে এখন নিখোঁজ। রায়পুরার গোবিন্দপুর এলাকার শাহীনুর বেগমের ছেলে শিপন ভূঁইয়া স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস এইটে পড়তো। চার মাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর সম্প্রতি জানা গেছে, সেও ইন্দোনেশিয়ার কারাগারে আটক আছে।

শাহিনুর বেগম বলেন, তার ছেলেকে এর মাঝে চারবার বিক্রি করা হয়েছে। “ছেলেকে লোভ দেখিয়েছে নিয়ে গেছে। বলছে বিদেশ যেতে কাগজপত্র, টাকা-পয়সা কিছুই লাগবে না। তাই লেখাপড়া ছেড়ে টাকা-পয়সা রোজগারের লোভে চলে গেছে।”

‘পরিবারের দায়ও কম নয়’

শাহিনুর বেগমের বাড়িতে সাংবাদিক এসেছে খবর পেয়ে আশ-পাশ থেকে উদ্বিগ্ন অনেকে সেখানে ভিড় করেন। তারা পরিবারের নিখোঁজ স্বজনদের বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন। কারও ভাইয়ের ছেলে, কারও বোনের জামাই, কারও সন্তান সমুদ্রপথে রওনা হওয়ার পর থেকে খবর নেই। এদের মধ্যেই একজন আছিয়া বেগম বলছিলেন, তার ছেলে কাছেই একটি মুরগীর খামারে ৫ হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন । তা দিয়ে টেনেটুনে মন্দ চলছিল না তাদের। কিন্তু ছেলে চলে গেছে মাকে না জানিয়ে।

তবে স্থানীয় সাংবাদিক হাবিবুর রহমান বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে পরিবার থেকেও উৎসাহ থাকে। ছেলেরা এভাবে গিয়ে টাকা পয়সা পাঠাচ্ছে আর বাড়িতে বাবা-মায়েরা পাকা দালান তুলছে। তাদের পক্ষ থেকে তো বাধা নেই।”

কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা চলছে এবং কর্মসংস্থানের অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তাহলে এভাবে দেশ ছাড়ার কারণ কি?

অভিবাসী ও শরণার্থী বিষয়ে গবেষক, রামরুর চেয়ারপার্সন তাসনিম সিদ্দীকীর ভাষ্য, উন্নয়নের ধারা চলমান হলেও তার সুফল সবার কাছে পৌছাচ্ছে না। তিনি বলেন,” বাংলাদেশ অবশ্যই মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। কিন্তু এটা কিন্তু সবার কাছে পৌছাচ্ছে না। ফলে একেবারে নিচের শ্রেণীর যারা তারা মরীয়া হয়ে মাইগ্রেশনের পথ বেছে নেয়”।

bgb
কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলে বিজিবি সদস্যদের পাহারা (ফাইল ছবি)

‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতাও দায়ী’

নরসিংদী এলাকায় যে পরিবারগুলোর সাথে কথা হয় তাদের কেউই থানায় গিয়ে মামলা করেননি। নিখোঁজ স্বজনটির ক্ষতির আশংকাই এর কারণ। অনেকের অভিযোগ স্থানীয় কিছু দালাল এলাকা ছাড়লেও কেউ কেউ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে ।

অন্যদিকে পুলিশের দাবি বেশিরভাগ পরিবার থানায় অভিযোগ করছেন না বলে অপরাধীদের পাকড়াও করা যাচ্ছে না জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম জানান, পাচার সংক্রান্ত-৫০টির বেশি মামলা তদন্তাধীন আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অজ্ঞাত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে।

কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের নীরব অবস্থানকেও এইসব মানুষের অবৈধ পথে যেতে উৎসাহী হওয়ার কারণ বলে মনে করেন অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী। তার প্রশ্ন, কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূল থেকে এত শত শত লোক চলে গেল আর কেউ তা দেখল না? এখানে প্রশাসনের সর্বস্তরেই উদাসীনতা দেখা গেছে বলে তিনি মনে করেন।

২০১৩ সালের অভিবাসন আইন ও মানবপাচার আইনের মাধ্যমে দালাল চক্রের বিচার করতে উদ্যোগ না নিলে এই স্রোত ঠেকানো যাবে না বলেও তিনি আশংকা করেন।

সরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর যথযাথ উদ্যোগের অভাব

সরবকারিভাবে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ করার উদ্যোগের অভাবও এই মরীয়া অভিবাসন চেষ্টার একটি বড় কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। জিটুজি প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় মাত্র সাড়ে সাত হাজার লোক পাঠানো হয়েছে। ফলে যারা বৈধ পথে যেতে পারছে না সেই বিশাল সংখ্যায় মানুষ এই অবৈধ পথটি বেছে নিচ্ছে।

তবে সরেজমিনে খোঁজ-খবর করে দেখা যাচ্ছে, শুধু গরীব কর্মহীন শ্রেণীর লোকেরাই সমুদ্রপথে অবৈধভাবে দেশ ছাড়ছে তেমনটি নয়। যাদের নিজের এলাকায় শ্রমিক হিসেবে বা অন্য কোনও কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে, তারাও যাচ্ছে শুধুমাত্র দ্রুত বড়লোক হওয়ার লোভে পড়ে।

সূত্র: বিবিসি