ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দিনের সফর শেষে ফিরে গেছেন দিল্লীতে। তার এই সফরে বাংলাদেশ-ভারতের বিভিন্ন ইস্যুতে মোট ২২টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে।এখন হিসেব চলছে এই চুক্তিগুলো থেকে দু’দেশের প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি নিয়ে। তবে এখানে বাংলাদেশের প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিই বেশি, যা পুরো দেশবাসীকে হতাশ করেছে।
যেসকল চুক্তি বা সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর হয়েছে তার অধিকাংশেরই বিশেষ করে কানেক্টিভিটি বা ট্রানজিট এবং ঋণের বিষয়ে করা চুক্তির বিস্তারিত বিষয়বস্তু দুই দেশের কেউই প্রকাশ করেনি।
ভারতকে ট্রানজিট, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জায়গা দেয়া— এসব সুবিধা বাংলাদেশ দিয়েছে, কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তিগুলো প্রায় ধোঁয়াশা। পুরো সফর এবং চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের স্বার্থ বেশি রক্ষা করা হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে সম্পাদিত ২২টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ণের বিষয়টি বাংলাদেশের আরও ৪১ বছর আগে পাওয়ার কথা ছিল, যা মোদির সফরে মিলেছে। বহু প্রতীক্ষিত তিস্তা বিষয়ে মুখের বুলি পাওয়া গেছে, কোনো চুক্তি হয়নি। বাণিজ্য চুক্তির নবায়ন করা হয়েছে, নৌপথে ট্রানজিট ও বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
ভারতের ঋণের বিষয়ে সমঝোতা, বাংলাদেশের মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ভারত ব্যবহারে সমঝোতা, ভেড়ামারায় ভারতকে অর্থনৈতিক অঞ্চল দেয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। কিন্তু এই সমঝোতা স্মারকেরও বিস্তারিত এখনো দু’দেশের কেউই প্রকাশ করেননি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি এখনো কোনো চুক্তির বিস্তারিত হাতে পাইনি, তাই বলা যাচ্ছে না। তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র শক্তিশালী হলে সাবধানে এবং দেখেশুনে চলতে হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে, শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিবেশী কম শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রতি ছোটভাই সুলভ আচরণ করে। শক্তিশালী রাষ্ট্র সব সময়েই প্রতিবেশীর প্রতি ‘বিগ ব্রাদার’ বা ‘এল্ডার ব্রাদার’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। যাকে বাংলায় বলে দাদাগিরি।
তিনি আরও বলেন, এর আগে প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশকে ১০০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা দিয়েছিলো। কিন্তু সেটা ছিল সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট। যার মানে হচ্ছে, ঋণের অর্থ ভারতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। ঋণের অর্থে যে উন্নয়ন হবে, ঐ উন্নয়নের জন্য যে কাঁচামাল লাগবে তার মূল্য ঠিক করে দেবে ভারত, আবার সেই কাঁচামালের মূল অংশ ভারতের কাছ থেকেই কিনতে হবে।
ড. বারাকাত আরো বলেন, যারা এগুলো নিয়ে উচ্ছ্বসিত, তারা এই চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক বা প্রটোকলের কতখানি জানেন বা দেখেছেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এর আগে ৮০-এর দশকে ভারতের ঋণের অর্থে বাংলাদেশে কলম উৎপাদিত হলো। পরে দেখা গেল যে,কলম আগে বাজারে এক টাকায় বিক্রি হতো। পরে তার দাম বেড়ে দ্বিগুণ হলো।
এবারের ঋণের টাকাও প্রায় একইভাবে ব্যবহার করতে হবে বলে জানিয়েছে ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং ইকোনমিকস টাইমস পত্রিকা। ভারতের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট (এক্সিম) ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যদুভেন্দ্র মাথুরকে উদ্ধৃত করে পত্রিকা দুটি জানায়, বাংলাদেশ সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেয়া ২০০ কোটি ডলার তথা সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণে (লাইন অব ক্রেডিট) ৫০ হাজার ভারতীয়র কর্মসংস্থান হবে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, এক্সিম ব্যাংকের মতো ঋণদানকারী সংস্থাগুলো এই ঋণ প্রদান করবে। শর্ত হিসেবে ঋণগ্রহণকারীকে এই টাকায় বিএইচইএল, আইটিইএসসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের ভারতীয় উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সরঞ্জামাদি এবং সেবা নিতে হবে।
তবে মোদির এই সফরকে ব্যবসায়ীরা সম্পর্ক উন্নয়ণের সফর বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, এই সফরের ফলে দু’দেশের মধ্যে ব্যবসায়ীক সেতুবন্ধন আরো দৃঢ় হবে।
তবে সরকারী দলের নেতারা এটিকে দেশের জন্য একটি সফল সফর বলছেন। এদিকে খালেদা জিয়া মোদির সাথে দেখা করলেও বিএনপির অনেকেই মোদির সফর থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তির হিসেব কম থাকায় সমালোচনা করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর।
যে যেভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন সাধারণ মানুষ মনে করছে এই সফর থেকে বাংলাদেশের মানুষের তেমন কোন প্রাপ্তিই নেই। কারণ তাদের প্রাণের দাবি তিস্তা চুক্তির মৌখিক আশ্বাস পাওয়া গেছে শুধু, কিন্তু তা কার্যকরের কোন সম্ভবনাও দেখছেন না দেশের মানুষ।
সৌজন্যেঃ প্রতিক্ষণ