‘ব্লগ কি বুঝি না, আর তার লেখাও আমরা দেখিনি। হুজুরের পরামর্শ, সে ইসলামবিরোধী। তাকে হত্যা করা ঈমানি দায়িত্ব। আর সেই ঈমানি দায়িত্ব পালন করতে ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছি’।
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার সঙ্গে জড়িত দুই মাদ্রাসার ছাত্র জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম আটকের পর পুলিশের কাছে এমন তথ্য দিয়েছেন।
ডিএমপি’র তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার আটককৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
সোমবার (৩০ মার্চ) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান তার দক্ষিণ বেগুনবাড়ির বাসা থেকে কর্মস্থল মতিঝিল ফারইস্ট ট্রাভেল এজেন্সি অফিসে যাওয়ার জন্য বের হলে তিনজনক তাকে উপর্যুপরি কুপিয়ে আহত করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয়।
কুপিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ও টহলরত তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ ধাওয়া দেয়। এক পর্যায়ে চট্রগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসার ছাত্র জিকরুল্লাহ ও রাজধানীর মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র আরিফুল ইসলামকে রক্তমাখা চাপাতিসহ আটক করে।
এর পর পরই পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হয়েছে বলে আটককৃতরা স্বীকার করেছেন।
তিনি আরও বলেন, রোববার (২৯ মার্চ) বিকেলে আটককৃত জিকরুল্লাহ, আরিফ ও পালিয়ে যাওয়া তাহের তিনজন মিলে ওয়াশিকুরের বাসা রেকি করেন। সোমবার সকালে তিনি বাসা থেকে বের হওয়া মাত্র তাকে হত্যা করা হবে বলে পরিকল্পনা করেন।
সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা সোমবার সকালে সেখানে অবস্থান গ্রহণ করে। ওয়াশিকুর রহমান বাসা থেকে বের হয়ে সামনের দিকে এগোনো মাত্রই জিকরুল্লাহ ও তাহের চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে স্থানীয় লোকজন ও টহলরত পুলিশ ধাওয়া করলে আরিফ ও জিকরুল্লাহ ধরা পড়েন। তবে তাহের পালিয়ে যান। আরিফের ব্যাগ থেকে চাপাতি পাওয়া যায়।
বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, তাদেরকে হুজুর জানিয়েছেন, ওয়াশিকুর রহমান ধর্মের বিরুদ্ধে ব্লগে লেখালেখি করেন। আর এ কারণে তাকে হত্যা করা ঈমানি দায়িত্ব। আর এ দ্বায়িত্ব পড়ে এদের ওপর। গত শনিবার (২৮ মার্চ) জিকরুল্লাহ চট্রগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসা থেকে এ কাজের জন্য ঢাকায় এসে যাত্রাবাড়ীর একটি মসজিদে অবস্থান নেন। রোববার হত্যার মিশন নিয়ে পরিকল্পনার জন্য তারা একসঙ্গে মিলিত হন এবং নিহত ওয়াশিকুরের বাসা রেকি করেন।
কারা হত্যার নির্দেশদাতা, তারা কোনো ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠন কি-না এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি ডিসি বিপ্লাব কুমার সরকার।
তবে তিনি বলেন, যেহেতু জিজ্ঞাসাবাদেও এটি একেবারেই প্রাথমিক পর্যায় সেহেতু আরো বিশদভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এসব বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, এর শেকড় কোথায় তা আমরা খতিয়ে দেখবো। থানায় গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক টিম ও র্যাবের একাধিক টিম আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পর বিকেল চারটার দিকে তাদের মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নেয়া হয়।
পুলিশ ও র্যাবের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, সর্বশেষ লেখক-ব্লগার অভিজিৎ, চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় ইসলামী অনুষ্ঠান উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, লুৎফর রহমান, ব্লগার রাজিবসহ বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা একই ধরনের হওয়াতে আটককৃতদের কাছ থেকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
কর্মকর্তারা বলেন, যেহেতু তারা হাতেনাতে ধরা পড়েছেন, এমনকি যে চাপাতি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে সেই রক্তমাখা চাপাতিও উদ্ধার হয়েছে সেহেতু এ মামলাসহ কারা এসব ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে, সেসব বিষয়েও বিশদ তথ্য পাওয়া যাবে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, সাতরাস্তা থেকে পূর্বদিকে ২০০ গজ দূরে মধ্য বেগুনবাড়ির এক গলির রাস্তায় বিসমিল্লাহ মঞ্জিল নামের বাড়ির দ্বিতীয় তলার এক রুমে থাকতেন ওয়াশিকুর রহমান। তার বাসার পাশের ৪/২ নম্বর বাড়ির সামনেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, খুনিরা আগে থেকে রাস্তার দুই পাশে ওঁৎ পেতে ছিলেন। ওয়াশিকুর বাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্রই প্রথমে পেছন থেকে চাপাতি দিয়ে কোপানো শুরু করেন। এরপর তিনি বাঁচার চেষ্টা করলেও চারদিক থেকে মাথা-ঘাড়ে কোপান। ধারালো চাপাতির কোপে ওয়াশিকুর রহমান বাবুর শরীর থেকে মাথা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
শিল্পাঞ্চল থানার ওসি সালাহ উদ্দীন আহমেদ জানান, এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। নিহতের পরিবারের লোকজন থানায় এলে হত্যা মামলা দায়ের করা হবে। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম।