Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

Shiri১৯৯৯ সালে ‘সাউথ কোরিয়ান নিউজ’ পত্রিকার শিরোনাম ছিল, “শিরি নামের একটি ছোট্ট মাছ ‘টাইটানিক’কে ডুবিয়ে দিয়েছে।” জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক সিনেমাটি পৃথিবীর নানা প্রান্তের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার বক্স-অফিসে নতুন রেকর্ড গড়েছিল। কিন্তু ক্যাং জায়ে-কিউ নির্মিত এ দেশেরই ফিল্ম ‘শিরি’ [১৯৯৯] ভেঙে দেয় সেই রেকর্ড। যুক্তরাষ্ট্রে টাইটানিক যেখানে সক্ষম হয়েছিল সচরাচর সিনেমা না দেখা সাধারণ মানুষকেও হলমুখী করতে, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় শিরি দেশটির সাধারণত সিনেমাবিমুখ দর্শকদেরও তুমুল আকর্ষণ করে হয়ে ওঠে একটি সাংস্কৃতিক ফেনোমেনা। এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের সে সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যখন জর্জরিত, তখন শিরির এমন বাণিজ্যিক সাফল্যের প্লাবন আসলে ইন্ডাস্ট্রিটিকেই বাঁচিয়ে দেয়।

শিরি হলো উত্তর কোরিয়ান এক নারী স্পাই/স্নাইপার ও দক্ষিণ কোরিয়ান এক স্পেশাল এজেন্টের মধ্যে সম্পর্কের একটি গড়পড়তা অ্যাকশন-মেলোড্রামা। ফিল্মটির প্রতি আমজনতার এমন উচ্ছ্বাস সত্ত্বেও সমালোচকরা একেবারেই আগ্রহ দেখাননি। প্রডাকশন ভ্যালুর দিক থেকে এটি তখন নির্মিত বেশির ভাগ সিনেমার চেয়ে ভালো কিছু আদতেই হয়নি। এর চেয়েও ভালো মানের অ্যাকশন-মেলোড্রামা ধারার সিনেমা দেখে কোরিয়ান দর্শকরা যে অভ্যস্ত, সমালোচরা অন্তত তেমনটাই মনে করতেন। তবে একটি জিনিস দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় প্রত্যেক সাধারণ দর্শক মুহূর্তেই উপলব্ধি করতে পারলেও সমালোচকরা তা পারেননি; সেটি হলো— শিরিতে ‘রহস্যময়’ কিছু একটার উপস্থিতি। এই প্রথমবার দক্ষিণ কোরিয়ান দর্শকরা বড় পর্দায় উত্তর কোরিয়ান কোনো চরিত্রের দেখা পায় ‘কমিউনিস্ট বাস্টার্ড’ হিসেবে নয়, বরং একজন ‘মানুষ’ হিসেবে— যে কিনা অনেক দক্ষিণ কোরিয়ানের মতোই আদর্শের বেড়াজালে যন্ত্রণাকাতর। উত্তর কোরিয়ানরাও যে মানুষ, সেই উপলব্ধি সিনেমার ভেতর দিয়ে এই প্রথম করতে পেরে বেশির ভাগ দক্ষিণ কোরিয়ান দর্শকই চমকে গেছে। যদিও বাণিজ্যিকভাবে সফল সিনেমার সম্ভাবনাকে শিরি প্রমাণ করেছে, তবু এই সাফল্যের তাত্পর্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কাছে সহসাই স্পষ্ট হয়নি।

chardike-ad

এ ইন্ডাস্ট্রির ধারণা ছিল, অ্যাকশনে ভরপুর হলিউড স্টাইলের থ্রিলার ফিল্ম দিয়েই হলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলোর জবাব দেয়া সম্ভব। কিন্তু এ ধারণা থেকে নির্মিত বিগ বাজেটের বেশকিছু অ্যাকশন ফিল্ম বক্স-অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। ইন্ড্রাস্ট্রিটি তখনো বুঝতে পারেনি, কোরিয়ান সিনেমাকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো কিছু একটা রয়েছে শিরির মধ্যে। অর্থাত্ কোরিয়ান জনগণের সমন্বিত স্মৃতিচারণা, ইতিহাস ও জাতীয় আত্মপরিচয়ের যে আবেদনকে ফিল্মটি ধারণ করেছে, সেটি হলিউডের কোনো ফিল্মের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।

১৯৯৯ সালের পর থেকে ২০০২ সালে শুধু ‘লর্ড অব দ্য রিংস: টু টাওয়াস’ ছাড়া যে সিনেমাগুলো সে দেশে বক্স-অফিসের শীর্ষস্থানে ছিল, তার সবই কোরিয়ান। শিরি, ‘জেএসএ: জয়েন্ট সিকিউরিটি এরিয়া’, ‘তায়ে গুক-গি ব্রাদারহুড’, ‘সিলমিদো’ ও ‘ওয়েলকাম টু দংমাকগোল’ শীর্ষস্থানে থাকা সব ফিল্মই উত্তর কোরিয়া, স্নায়ুযুদ্ধ কিংবা পুনর্মিলনী সম্পৃক্ত। ‘ফ্রেন্ডস’ ও ‘মেমোরিজ অব মার্ডার’-এ সম্মিলনের আবেদন থাকলেও আশির দশকের শুরুর দিকের যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতিচারণাকে ধারণ করেছে ফিল্ম দুটি। ‘কিং অ্যান্ড দ্য ক্লাউন’-এর কাহিনী ষোড়শ শতকের শুরুর দিকের; য়ি ডাইনাস্টির একটি ট্র্যাজিক কাহিনীর পুনরাবৃত্তি। অর্থাত্ নিজেদের স্মৃতিগাথা, অভিজ্ঞতা ও গল্পকে পুনর্মুল্যায়নের মধ্য দিয়েই স্থানীয় দর্শকদের আকর্ষণ করতে সফল হয়েছে কোরিয়ান সিনেমা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, কোরিয়ান দর্শকদের কোরিয়ান যে কাহিনী দেখায় কোরিয়ান সিনেমা, তাতে গুরুত্ববাহী কিছু নেই। কিন্তু প্রকৃত অর্থে, এই সাধারণ উপলব্ধিই কোরিয়ান সিনেমার সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে গেছে। আর এটি গুটি কয়েক ফিল্মমেকার বা কোনো নির্দিষ্ট ধারা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট ফিল্ম মুভমেন্টকে নয়, বরং স্থানীয় বাজারে পুরো কোরিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকেই দাঁড় করিয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে। অর্থাত্ কিছু সময়ের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রায় সাফল্যকে উপভোগ করা অন্যান্য ন্যাশনাল সিনেমার মতো করে কোরিয়ান সিনেমা নিজেকে কোনো নির্দিষ্ট ধারা কিংবা নির্দিষ্ট স্টাইলের দিকে ঠেলে দেয়নি। বরং কোরিয়ান সিনেমার ধারা বা স্টাইল হলো ‘বহুমুখী’।

যেমন ধরুন, জাপানের যুদ্ধোত্তরকালীন সিনেমা কিংবা চীনের পঞ্চম প্রজন্মের সিনেমা আন্তর্জাতিক দর্শকদের আকর্ষণ করেছে বিদেশীয় ঢঙের ড্রামা দিয়ে। হংকংয়ের সিনেমা মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে মার্শাল আর্ট ফিল্ম আর কপ-মুভি দিয়ে। অতিসূক্ষ্ম রাজনৈতিক বার্তাসহকারে নিষ্পাপতা আর নিষ্কলুষতার জাদু দিয়ে সিনে-জগতের উর্বর ভূমি হয়ে উঠেছে ইরান। তাইওয়ানের সিনেমা একটি শৈল্পিক আভার দ্যুতি দিয়ে কিছু সময়ের জন্য আর্ট-হাউস সিনেমার প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এসব ফিল্ম ট্রাডিশন ও মুভমেন্ট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। কেননা স্থানীয় বাজারে দাঁড়ায়নি এগুলোর সাফল্য। সিনেমার ইতিহাস প্রমাণ দেয়, স্থানীয় দর্শকদের সমর্থন ছাড়া কোনো ফিল্ম-মুভমেন্ট দীর্ঘায়ু পেতে পারে না। বিশেষ করে যদি এসব মুভমেন্ট শুধু নিজ নিজ দেশেই টিকে থাকতে সক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে এগুলোর গ্ল্যামার নষ্ট হতে শুরু করলে পুরো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পতন হতে থাকে।

ভাবা যেতে পারে, অন্যান্য ন্যাশনাল সিনেমার মতো কোনো একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য স্থাপনের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কোরিয়ান সিনেমার ঘাটতি রয়ে গেছে। বরং সত্য হলো, কোরিয়ান সিনেমা প্রকৃত অর্থে সব বৈশিষ্ট্যকেই সাদরে গ্রহণ করেছে। যেমন ধরুন, সম্প্রতি নিজের শততম সিনেমা বানানো, কোরিয়ান সিনেমার জনকতুল্য ফিল্মমেকার ইম নৌন-তায়েক এখনো ড্রামার ওপর আস্থা রাখেন; জ্যাকি চ্যানকে আদর্শ মেনে মার্শাল আর্ট ফিল্ম নির্মাণেই আগ্রহ তরুণ ফিল্মমেকার ইয়ু সিয়ং-ওয়ানের; ইরানের আব্বাস কিয়ারোস্তামি প্রভাবিত নারী ফিল্মমেকার লি জুয়-হিয়াংয়ের ‘দ্য ওয়ে হোম’ [২০০২] সিনেমাটি দারুণ সাফল্য পেয়েছে। তাছাড়া তাইওয়ানের ফিল্মমেকার সিয়াও-সিয়েন হৌর সিনেমার সঙ্গে তুলনা করা হয় যার কাজকে, সেই হং স্যা-সু প্রায়ই নির্মাণ করেন হৌর সিনেমার চেয়েও অধিক নীরস সিনেমা।

শুধু বহুমুখী ধারা নয়, বরং ডকুমেন্টারি, এনিমেশন, এক্সপেরিমেন্টাল ও কমার্শিয়াল— বহু ধরনের ফিল্মমেকিংসহকারে ফিল্মমেকিংয়ের একটি সত্যিকারের পরিপূর্ণ সরণিকে ধারণ করে আছে কোরিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। হংকং যেখানে অবাণিজ্যিক সিনেমার ঘাটতির জন্য নিন্দিত, সেখানে তাইওয়ানে নেই বাণিজ্যিক ফিল্মমেকিংয়ের স্থায়িত্ব। ফলে কোরিয়ান সিনেমাকে প্রখ্যাত সিনে-সমালোচক ক্রিস বেরি ‘ফুল সার্ভিস সিনেমা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, কোরিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ও সিনে-সংস্কৃতি ভীষণমাত্রায় বহুমুখী। মূলধারার ফিচার ফিল্ম, একটি সক্রিয় ডকুমেন্টারি মুভমেন্ট, আর্ট সিনেমা, এনিমেশন, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, একটি স্বক্রিয় স্ক্রিংনিং প্রোগ্রাম-সমেত আর্কাইভ, প্রচুর ফিল্ম-স্কুল এবং আরো অনেক কিছুর সমারোহে দাঁড়িয়ে গেছে কোরিয়ান সিনেমা। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মতো ভীষণ সফল ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিই শুধু নয়, বরং সিনেমায় এ রকম পরিপূর্ণতার আদর্শভূমিও হয়ে উঠেছে দেশটি।

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কোরিয়ান সিনেমার সাম্প্রতিক সাফল্য ঈর্ষণীয়। স্থানীয় বাজারের ৬০ শতাংশ শেয়ার দখল করে রেখেছে এ দেশের সিনেমা; যা কিনা নিজ বাজারে রাজত্ব করা মাত্র তিনটি দেশের [বাকি দুটি হলো— যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত] মধ্যে অন্যতম করে তুলেছে কোরিয়ান সিনেমাকে। তাছাড়া সিনেমার ইতিহাসে কোরিয়া হলো একমাত্র দেশ, যে কিনা বিদেশী ফিল্মের কাছে স্থানীয় দর্শক হারানোর পর তা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।

একেবারেই পর্যুদস্ত অবস্থা থেকে কোরিয়ান সিনেমার এমন চরম ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া এখনো চলমান থাকায় পুরো প্রেক্ষাপটের কোনো স্পষ্ট চিত্র দাঁড় করানো দুরূহ। তবে সমকালীন কোরিয়ান সিনেমাকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা সম্ভব: প্রডিউসার-নিয়ন্ত্রিত ‘প্যাকেজ সিনেমা’, কোরিয়ান ব্লকবাস্টার সিনেমা ও ফিল্মমেকার-নিয়ন্ত্রিত ‘অথর’ সিনেমা। অবশ্য এ দেশের ব্লকবাস্টার সিনেমা ও আর্ট ফিল্মের মধ্যে ফারাকটা ঠিক অন্যান্য দেশের মতো অত প্রকট নয়। যেমন ধরুন, জেএসএ: জয়েন্ট সিকিউরিটি এরিয়া, ওয়েলকাম টু দংমাকগোল ও কিং অ্যান্ড দ্য ক্লাউনের মতো ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলো শুরুতে ইন্ডিপেনডেন্ট আর্টফিল্ম হিসেবে নির্মিত হলেও পরে অর্জন করেছে বিপুল জনপ্রিয়তা। শিম হুয়াং-রায়ে নির্মিত ২০০৭ সালের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘ডি-ওয়ার’ যুক্তরাষ্ট্রেই প্রদর্শিত হয়েছে ২ হাজারেরও বেশিবার। এটিতেও কিন্তু শুরুতে অর্থলগ্নি করেছিলেন ইন্ডিপেনডেন্ট ইনভেস্টররা। প্রকৃত অর্থে, বাণিজ্যিক আবেদন ও শৈল্পিক গুণমানের সমন্বয়ই কোরিয়ান সিনেমাকে এমন সাফল্য এনে দিয়েছে ।

আশির দশকের শেষ দিকে বেশ কয়েকজন নানা ধারার নতুন ও প্রতিভাবান ফিল্মমেকারের আবির্ভাব ঘটে দেশটির ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। আগেকার ফিল্মমেকাররা যেখানে প্রাচীন পন্থায় ফিল্মমেকিং শিখতেন, সেখানে এ ফিল্মমেকারদের বেশির ভাগই ছিলেন হয় ফিল্ম-বোদ্ধা [‘কোরিয়ান নিউ ওয়েভ’-এর অধিকাংশ ফিল্মমেকার], নয়তো ফিল্ম স্কুল থেকে পাস করে আসা [১৯৯৬-পূর্ব সময়ের অধিকাংশ ফিল্মমেকার]। ‘কোরিয়ান নিউ ওয়েভ’ ডিরেক্টররা যেখানে রিয়ালিজমের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন, সেখানে পরের প্রজন্ম বরং বেছে নিয়েছেন হাইব্রিড ধারার ফিল্ম; তবে তা ট্রাডিশনাল ধারার প্রতি সমর্থিত হলেও তাতে স্বতন্ত্র স্টাইল জুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তারা। এই দুই প্রজন্মের মধ্যবর্তী সময়েই ১৯৯৬ সালে ফিল্মমেকিংয়ে অভিষেক ঘটে সাম্প্রতিক সিনে-জগতের এক প্রতিমাতুল্য প্রতিভার; তার নাম কিম কি-দুক।

অনুবাদ : রুদ্র আরিফ, মূল : হিয়ুনজুম মিন