Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

vul‘ভুল’ শব্দটি লেখার সময়ই অনেকে ভুল করে লেখে ‘ভূল’। ভাষাশহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে যে প্রভাতফেরি হয়, সেখানে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে রক্তলাল-অক্ষরে লিখে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ জানানো হয়। কিন্তু বেশির ভাগ সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির শ্রদ্ধা নিবেদনে সামান্য খাদ থেকে যায়; তারা লেখে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’! অথচ ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতগণ পরিভাষা তৈরি করবেন, তার পরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন, আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব। সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’

বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত বক্তব্যের পর ৪৪ বছর পার হয়ে গেল। স্বাধীন দেশে বাংলা ভাষা ও বানানরীতি ঠিক করল বাংলা একাডেমি। পরিভাষাবিদরা তৈরি করেছেন পরিভাষা। তাও তো কত কাল কেটে গেল! সর্বস্তরে বাংলা তো চালু হয়ইনি, এমনকি আমাদের ভাষা-বানান নির্ভুল করে লেখার অভ্যাস পর্যন্ত হয়নি। রাজধানীর দোকানপাট, প্রতিষ্ঠান-ভবনের সাইনবোর্ডগুলোর দিকে তাকালেই বাংলা ভাষার করুণ অবস্থা বোঝা যায়। রাতের নগরে রঙিন আলোর খেলায় সাইনবোর্ড, দেয়াললিখনে একটু মনোযোগ দিলেই ভড়কে যেতে হয় হাজারো ভুল বানান দেখে। দেখা মেলে জ্বলজ্বল করছে ‘ষ্টোর্স’ (হবে স্টোর্স), (সঠিক বানানটা ব্র্যাকেটে দেওয়া হলো) ‘ষ্টোর’ (স্টোর), ‘এণ্ড’ (অ্যান্ড), ‘ঘন্টা’ (ঘণ্টা), ‘ইনষ্টিটিউট’ (ইনস্টিটিউট), ‘ষ্ট্যান্ড’ (স্ট্যান্ড), ‘ফ্যাক্টরী’ (ফ্যাক্টরি), ‘ফার্ণিচার’ (ফার্নিচার), ‘মডার্ণ’ (মডার্ন), ‘রেষ্টুরেন্ট’ (রেস্টুরেন্ট), ‘কম্পানী’ (কম্পানি) ‘আইনজীবি’ (আইনজীবী), ‘বিরাণী’ (বিরানি), ‘কর্ণেল’ (কর্নেল), ‘ষ্ট্যাম্প’ (স্ট্যাম্প), ‘ফটোষ্ট্যাট’ (ফটোস্ট্যাট), ‘ভ্রাম্যমান’ (ভ্রাম্যমাণ), ‘ডায়াগনষ্টিক’, (ডায়াগনস্টিক) ‘ব্যাটারী’ (ব্যাটারি), ‘মেশিনারী’ (মেশিনারি) ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘রেস্তোরাঁ’ শব্দটি প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় ‘রেঁস্তোরা’ বা ‘রেস্তোরা’ বানানে। ‘বেগম রোকেয়া সরণি’কে ভুল বানানে লেখা হচ্ছে ‘বেগম রোকেয়া স্মরণী’ বা ‘বেগম রোকেয়া স্বরণী’। সরণি মানে পথ বা রাস্তা। অর্থাৎ রোকেয়ার নামের পথটি হচ্ছে রোকেয়া সরণি। ‘গোল চত্বর’কে ভুল বানানে লেখা হচ্ছে ‘গোল চক্কর’। এতে ‘চত্বর’ আর ‘সরণি’র অর্থই পাল্টে যাচ্ছে। সাইনবোর্ডের অসংখ্য ভুল বানানের মধ্যে আছে ‘গর্ভণর’, ‘মডার্ণ’, ‘রেঁনেসা’, ‘রেজিষ্ট্রি’ ‘পঁচা’ (শুদ্ধ বানানগুলো হচ্ছে : গভর্নর, মডার্ন, রেনেসাঁ, রেজিস্ট্রি, পচা)।

chardike-ad

শুধু সাইনবোর্ডের ভুলই নয়, রাজনীতিকদের বানানের ওপর ‘অগাধ জ্ঞান’ দেখে তো রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। দেয়ালে চোখ পড়লে প্রায়ই দেখা যায় ‘জাতীর পিতা’। শুদ্ধ বানানটি হচ্ছে ‘জাতির পিতা’। অনেক সময় ছাত্রসংগঠনগুলোকে অদ্ভুত ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। ব্যানারে কী ভয়াবহ বানান! প্রায়ই লেখা থাকে ‘দূরশ্বাষনের’, ‘বিরোদ্ধে’, ‘কণ্ঠ সুর’, ‘স্বইরাচারী’, ‘বিক্ষুভ’ ইত্যাদি ভুল। (সঠিকগুলো হবে- দুঃশাসন, বিরুদ্ধে, কণ্ঠস্বর, স্বৈরাচারী, বিক্ষোভ)। সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বানানের অবস্থাটা আরো করুণ। ‘সুপ্রীম কোর্ট’, ‘আপীল’. ‘রেজিষ্ট্রার’, ‘সরকারী’, ‘লিঁয়াজো’ ইত্যাদি (প্রমিত বানান হবে : সুপ্রিম কোর্ট, আপিল, রেজিস্ট্রার, সরকারি, লিয়াজোঁ) সরকারি প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো লেখা রয়েছে বর্জিত ‘সরকারী’ বানানটি। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে ঢুকতেই ভুল বানানটি শিখে ফেলে।

শুধু রাজধানীর নয়, দেশের সর্বত্র যেন চলছে ভুল বানানের মহড়া। বাণিজ্যিক নগর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নগরজুড়ে ‘দেয়াললিখে’ আহ্বান জানিয়েছেন ‘দেয়ালে পোষ্টার’ না লাগানোর জন্য। কিন্তু পোষ্টার বানানটি ভুল; সঠিকটি হবে পোস্টার। আসকার দীঘির পারের ফার্নিচার দোকানগুলোর নাম ‘ফার্ণিশার্স’ লেখা! জুবিলি রোডের নামে আছে নানা বৈপরীত্য। কেউ ‘জুবলী’, কেউ ‘জুবিলী’। বিআরটিসি মোড়ে শাহী সার্ভিসের গাড়ি যাবে ‘লক্ষীপুর’, লক্ষ্মীপুরের যাত্রীরা তবু উঠে বসে। নগরের এক বাজারে কত রূপ দেখবেন ‘রিয়াজউদ্দিন বাজার’, ‘রেয়াজউদ্দিন বাজার’, ‘রেয়াজউদ্দীন বাজার’। সঠিক বানানটি হবে- রিয়াজউদ্দীন বাজার। কাজীর দেউরি, কাজীর দেউরী না কাজীর দেউড়ী- ধন্দ লাগতেই পারে সেখানে গেলেও। সঠিকটি হবে- কাজীর দেউড়ি। এসব ভুল শব্দ প্রতিদিন দেখতে দেখতে একদিন আমরাও ভুলে যাই সঠিক শব্দটি।

তবে ভালো খবরও রয়েছে। গত বছরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এমনই একটি সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কাকতাড়ুয়া’ নামে একটি সংগঠন। সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বাংলা বানান শুদ্ধি অভিযান শুরু করে তারা। দোকান, শপিং মল, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড সব খানেই ভুল বানানের ছড়াছড়ি। পিছিয়ে নেই সরকারি অফিসও। সেই ভুল বানান নিজ হাতে পরম মমতায় শুদ্ধ করে দিচ্ছে একদল তরুণ-তরুণী। ভাষার মাসে তারা ছুটছে রং-তুলি নিয়ে, ভুল বানানের ওপর রং-তুলির পরশ বুলিয়ে শুদ্ধ করে দিচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছরে ফেব্রুয়ারি মাসের এক দিন আগে থেকেই তারা শুরু করে মাসব্যাপী কার্যক্রম। কাকতাড়ুয়া এরই মধ্যে ১১৬টি প্রতিষ্ঠানের বানান শুদ্ধ করেছে। বাংলা বানান শুদ্ধি অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী গোলাম সারোয়ার শুভর সঙ্গে আরো রয়েছেন অভিজিত পাল, ফাতেমা তুজ জোহরা, আজিম হোসেন, মৌমিতা, তানজিয়া বিনতে হাই, হজরত আলী, রাসেল আহমেদ, বনানী ভট্টাচার্য, লুতফুন্নাহার, রবিউল ইসলাম, মোছাম্মত নুসরাত, জহির রায়হান, তানজিলা, সুমাইয়া রশীদ, উপমা দেবনাথ, রিতা আক্তার, আহমেদ আল মিনহাজ, প্রবাল দত্ত, সাকিন উল আলম, মাহির চৌধুরী, এ এইচ সুমন, নিশাত তানজুমসহ আরো অনেকে। তাঁরা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, এমসি কলেজসহ সিলেটের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী।

গত একুশে ফেব্রুয়ারির পর প্রতি মাসেই কাকতাড়ুয়ার সদস্যরা ঘুরে বেরিয়েছেন সিলেট শহরের অলিগলিতে। তাঁরা শুধু বাংলা ভুল বানান শুদ্ধ করেই বসে থাকেননি, পরবর্তী সময়ে একই ভুল যাতে অন্যরা না করে, সে ব্যাপারেও সচেতনতা তৈরির কাজটুকুও নিয়েছেন নিজেদের কাঁধে। বানান শুদ্ধির পরিকল্পনাকারী গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, দোকান, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে ফেসবুক অবধি এসব ভুলের বিস্তার। তাই আমরা ঠিক করেছি, এসব ভুলের বিপরীতে একটা সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’

শুধু সিলেট নয়, রাজধানীতেও ‘শুদ্ধ লিখি’ শিরোনামে কর্মসূচি পরিচালনা করছে ওয়ান ডিগ্রি ইনিশিয়েটিভ নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ওয়ান ডিগ্রি ইনিশিয়েটিভের এই উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শামিল হয়েছেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অংশগ্রহণকারীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় কর্মশালা। এই উদ্যোগ নিয়ে ফেসবুকেও ছিল প্রচারণা। কর্মসূচি উপলক্ষে খোলা ফেসবুক ইভেন্টে বিভিন্ন এলাকা থেকে ভুল বানানের ছবি আহ্বান করা হয়েছে। এসব ছবি দেখে আবার সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন ‘শুদ্ধ লিখি’র স্বেচ্ছাসেবকরা।

কর্মসূচি সম্পর্কে ওয়ান ডিগ্রি ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা সাবহানাজ রশীদ দিয়া বলেন, ‘রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড কিংবা পোস্টারে প্রায়ই বাংলা ও ইংরেজি শব্দের অদ্ভুদ সব বানান দেখা যায়। এটি ভাষার প্রতি অপমান। ভাষার প্রতি সম্মান দেখাতেই বছরব্যাপী শুদ্ধ লিখি কর্মসূচি চলবে।’

বানান ভুল বন্ধে আন্দোলন করতে হবে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক বলেন, ‘সাইনবোর্ডে ভুল, টেলিভিশনের স্ক্রলে ভুল, পত্রিকার পাতায় ভুল। ভুলের রাজ্যেই যেন আমাদের বসবাস। অথচ ইংরেজি বানান কেউ ভুল করে না। যত অবজ্ঞা আর অবহেলা বাংলা বানানে!’ কালের কন্ঠ।