মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ছাড়া এবার আন্তর্জাতিক কোনো ফ্লাইটেই উঠা যাবে না। চলতি বছরের নভেম্বরের পর থেকে কোনো এয়ারলাইন্সই হাতে লেখা পাসপোর্টধারীকে ভ্রমণ করাবে না তাদের উড়োজাহাজে। মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, দুবাই, কুয়েতসহ অধিকাংশ দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকা) এ নির্দেশনা জারি করেছে।
বাংলাদেশ সরকারও প্রবাসী বাংলাদেশীদের জরুরিভিত্তিতে এমআরপি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। রাষ্ট্রদূতদের বলা হয়েছে, প্রয়োজনে আউটসোর্সিংয়ের (বাইরের প্রতিষ্ঠান) মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় বাজেটও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, প্রবাসীরা আবেদনের পর অনেক অপেক্ষা করেও এমআরপি পাচ্ছেন না। বরং হয়রানির শিকার হচ্ছেন নানা ভাবে।
অভিযোগ রয়েছে, দ্রুততম সময়ে পাসপোর্ট প্রাপ্তির এ গ্যাঁড়াকলে প্রবাসীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েকটি দূতাবাসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেট। কোথাও যাচাই-বাছাই না করেই দেয়া হয়েছে বাইরের কোম্পানিকে কাজ, আবার কোথাও কার্যাদেশ দেয়ার পরও এসব কোম্পানিকে সহযোগিতা করা হচ্ছে না। বরং এ চক্রের দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে আবেদন না করলে হয়রানি করা হচ্ছে প্রবাসীদের। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় এ ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি।
সৌদি আরব প্রবাসী রিদোয়ান জানান, তিনি ২ মাস আগে এমআরপির জন্য আবেদন করেছেন। এ সময়ে তিনি একাধিকবার বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়েও পাসপোর্ট পাননি।
সৌদি দূতাবাস সূত্র জানায়, দেশটিতে প্রবাসী বাংলাদেশী বেশি থাকায় সেখানে জরুরিভিত্তিতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এমআরপি প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু দূতাবাসের একটি সিন্ডিকেট মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে নিজেরাই এমআরপি তৈরি করতে শুরু করে। এতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব প্রবাসীদের দ্রুততম সময়ে এমআরপি দেয়ার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইরিশ কর্পোরেশন বারহাদকে কাজ দেয়া হয়। কিন্তু রিয়াদে নানা সমস্যার কারণে ওই কোম্পানি সৌদি আরবে কাজ করতে পারছে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৯ নভেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিবকে (দ্বিপাক্ষিক) সভাপতি করে এমআরপি মনিটরিং টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এরপরও সৌদি আরবে এমআরপি কাজের অগ্রগতি হচ্ছে না। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সৌদি আরবের ২০ লাখেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশীর এমআরপি পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। একই অভিযোগ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও।
আইকার নির্দেশনা অনুযায়ী, ২৪ নভেম্বরের মধ্যে সব অভিবাসীকে এমআরপি প্রদান করতে হবে। যদি তা না হয়, তাহলে তারা অবৈধ বলে গণ্য হবেন। বছরে ১৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠানো বাংলাদেশী এসব শ্রমিকদের এমনকি দেশে ফিরে আসাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, অভিবাসীদের সমস্যা, দেশের অর্থনীতি এবং বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর লোকবল ও যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা বিবেচনা করে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অন্যান্য দেশে অভিবাসীদের এমআরপি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। উচ্চ মহলের ওই সিদ্ধান্তে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট কোম্পানি আবেদনকারীদের দোরগোড়ায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ, ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ ও ডিজিটাল স্বাক্ষর সংগ্রহ এবং ছাপানো পাসপোর্ট বিতরণের কাজ করবে। বিদেশী মিশনগুলোতে অবস্থিত অফিসার ও সহায়ক কর্মচারীরা প্রশাসনিক কাজ এবং আউটসোর্সিং কোম্পানিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবেন।
বলা হয়, অভিবাসীদের যদি তাদের কর্মক্ষেত্র থেকে দূতাবাসে এমআরপি নেয়ার জন্য যেতে হয়, তাহলে তাদের সময় এবং অর্থ উভয়ই ব্যয় করতে হবে। আউটসোর্সিং এ থেকে তাদের পরিত্রাণ দেবে।
গত বছর ২১ জুলাই বারহাদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি অনুসারে কোম্পানিটি সৌদি আরবে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে আবেদন প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র চালু করে। কিন্তু রিয়াদ দূতাবাস কোম্পানিটিকে সহায়তা না করায় কোম্পানিটি কাজই যথাযথভাবে শুরু করতে পারেনি। এ কোম্পানি সূত্র বলছে, দূতাবাসের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা তাদের কাজে বাধা দিচ্ছেন। মোহাম্মদ আইয়ুব নামে এক কর্মচারী দালাল চক্রের মাধ্যমে অভিবাসীদের দূতাবাস থেকে এমারপি নিতে প্রলুব্ধ করছেন। এজন্য আবেদনকারীকে অতিরিক্ত ১০০ থেকে ২০০ সৌদি রিয়াল দিতে হচ্ছে।
অভিবাসীদের অভিযোগ, যদি দালাল চক্রের মাধ্যমে আবেদন না করা হয় তাহলে কারও এমআরপি ইস্যু করা হয় না। যখন অভিবাসীরা সরাসরি দূতাবাসে যান আইয়ুব তাদের নিরুৎসাহিত করেন। আবেদনপত্রে নানা ভুল আছে এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই বলে হয়রানি করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সৌদি প্রবাসী জানান, এভাবে যদি ১৫ লাখ সৌদি অভিবাসীর কাছ থেকেও এমআরপি বাবদ জনপ্রতি ১০০ সৌদি রিয়াল অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয় তাহলে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩১৫ কোটি টাকা।
মূলত এ কারণেই সংশ্লিষ্টরা আইরিশ কোম্পানির কাজে বাধা দিয়ে চলেছে। আইয়ুব সিন্ডিকেট রিয়াদ এবং জেদ্দায় কনস্যুলেট ব্যতীত অন্য কোথাও এমআরপি ফি না দিতে পরিপত্র বিতরণ করছে। সূত্রঃ যুগান্তর।