জাতিসংঘের অধীনে সাত দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত বহুজাতিক বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল সোমবার সুন্দরবনে পৌঁছেছে। তারা সুন্দরবনে তেলের ক্ষতির প্রভাব কমাতে কাজও শুরু করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সন্ধ্যায় সেখানে পৌঁছে বর্তমানে কর্মরত সরকারি, বেসরকারি ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের কাছ থেকে ধারণা নেন। আজ এ বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা দুর্ঘটনাস্থল এবং সুন্দরবনের যেসব স্থানে তেল ছড়িয়ে পড়েছে তা পরিদর্শন করবেন। তারপর তারা নির্ধারণ করবেন ঠিক কত দিন বহুজাতিক বিশেষজ্ঞ দলকে সেখানে অবস্থান করে কাজ করতে হবে।
সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে গত ৯ ডিসেম্বর তেলবাহী একটি জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষে ওটি সাউর্দান স্টার-৭ নামে একটি তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যায়। এতে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের এ বনভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ে। সুন্দরবনের ভেতরে তেল নিঃসরণের এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ। বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস এবং পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকারি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদের নিয়ে সরকারকে সহায়তায় আগ্রহ ব্যক্ত করে এ বিশ্ব সংস্থা। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সহায়তা কামনা করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় ইউএনডিপির কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান সৈয়দা নাজনীন ফেরদৌসী সোমবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশসহ সাত দেশের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত ‘দ্য ইউনাইটেড নেশনস সুন্দরবনস ওয়েল স্পিল রেসপন্স মিশন’ সোমবার সকালেই সুন্দরবনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে।তিনি জানান, ওই প্রতিনিধি দলটি তেল পরিষ্কার করা, পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং পর্যায়ক্রমে ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে সুরক্ষার একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকারকে সহায়তা করবে। ওই প্রতিনিধি দলের মধ্যে তেল ছড়ানো বন্ধ, পেট্রো-ক্যামিকেল এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা
অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।ইউএনডিপি জানিয়েছে, প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ঢাকা ও সুন্দরবনে অবস্থান করে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করে বিষয়টি নিয়ে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন। আগামী দিনে ওই প্রতিনিধি দল সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে।প্রতিনিধি দলে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর, বন বিভাগ এবং বন গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রামের মেরিন সায়েন্স ইন্সটিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াইল্ড লাইফ কনসারভেশন সোসাইটির প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আছেন ফ্রান্সের দুজন দুর্ঘটনাজনিত পানিদূষণ বিশেষজ্ঞ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ফিনল্যান্ডের একজন দুর্যোগ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, সুইডেনের একজন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ, জাপানের একজন লজিস্টিক সমন্বয়কারী, কানাডার একজন তেল নিঃসরণ বিশেষজ্ঞ এবং ইউএনডিপির দুজন দুর্যোগ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ।
প্রতিনিধি দলের সঙ্গে থাকা ইউএনডিপির কর্মকর্তা কাওসার আহমেদ শেখ মোহাম্মদ সোমবার রাতে যুগান্তরকে জানান, বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা স্থানীয় সরকারি ও এনজিও প্রতিনিধি দলের কাছ থেকে ওই ঘটনার বিষয়ে ব্রিফ্রিং নিচ্ছেন। মঙ্গলবার তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে। তারপর তারা ঠিক করবে কত দিন তারা সুন্দরবনে অবস্থান করবে।জাতিসংঘ অবশ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার পক্ষে। জাতিসংঘ এও মনে করে যে, সচরাচর পরিবেশের ওপর এ ধরনের দুর্ঘটনার দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব পড়ে থাকে এবং সেই পরিবেশের পুনঃসংরক্ষণে বহু প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়। বন সংলগ্ন জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল জনপদেও এর প্রভাব পড়বে। উল্লেখ্য, তেল নিঃসরণের এলাকাটি চাঁদপাই অভয়ারণ্যসংলগ্ন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত সর্ববৃহৎ সংরক্ষিত জলাভূমি এবং গাঙ্গেয় ও ইরাবতী নামক দুটি বিপদাপন্ন ডলফিন প্রজাতির বিচরণ ক্ষেত্র।মংলা প্রতিনিধি আমির হোসেন আমু জানান, শ্যালা নদীতে ট্যাংকারডুবির ঘটনায় সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণে জাতিসংঘ ও ইউএনডিপির ২৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল এখন সুন্দরবনে অবস্থান করছে।
সোমবার বিকালে মংলায় পৌঁছে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডাক বাংলোয় প্রতিনিধি দলের প্রধান অ্যামিলিয়া ওয়ালসন জানান, বেশ কয়েক দিন সুন্দরবনে অবস্থান করবেন তারা। সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন শেষে প্রেস ব্রিফিং করে অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য জানানো হবে। সোমবার সকালে সড়কপথে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে বিকাল ৫টায় মংলায় পৌঁছে প্রতিনিধি দলটি ট্রলারযোগে সুন্দরবনের শ্যালা নদী ও চাঁদপাই রেঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়। বেসরকারি একটি ট্যুরিজম কোম্পানির লঞ্চে করে তারা সুন্দরবন ঘুরে বেড়াবে। সোমবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ প্রতিনিধি দলটি চাঁদপাই স্টেশনে পৌঁছে রাত যাপনের প্রস্তুতি নেয়। মঙ্গলবার সকাল থেকেই মূলত তারা কাজ শুরু করবে।সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের ডিএফও আমীর হোসেন চৌধুরী জানান, সুন্দরবনের অবস্থানকালে এ দলটি শ্যালা নদীসহ বনের বিভিন্ন খাল ও জলরাশিতে জলজ ও বন্যপ্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণ করবে। দেখবে বনের বৃক্ষরাজীর বর্তমান অবস্থাও।
প্রায় এক সপ্তাহ এ দলটি সুন্দরবনে অবস্থান করবে।বাগেরহাট প্রতিনিধি শওকত আলী বাবু জানান, সুন্দরবনে জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকারডুবির ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘের ‘জয়েন ইউএন গভর্নমেন্ট ওয়েল স্পিল রেসপন্স মিশন’র একটি প্রতিনিধি দল সোমবার বিকালে বাগেরহাটের মংলায় পৌঁছেছে। তারা রাতে পশুর নদীতে লঞ্চে অবস্থান করবে। আজ তাদের পরিদর্শনের জন্য সুন্দরবনে যাওয়ার কথা রয়েছে।’ এদিকে বিকালে মংলাস্থ সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের জেটিতে দাঁড়িয়ে পরিদর্শক দলের জন্য নির্ধারিত লঞ্চে ওঠার সময়ে জাতিসংঘের এই ‘জয়েন ইউএন গভর্নমেন্ট ওয়েল স্পিল রেসপন্স মিশন’র প্রধান অ্যামিলিয়া ওয়ালসম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে সুন্দরবনে জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি পরিদর্শন করতে এসেছি। এখান থেকে আমাদের সদস্যরা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত ও উপকরণ সংগ্রহ করবেন। পরে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই বোঝা যাবে প্রকৃতপক্ষে এ দুুর্ঘটনায় সুন্দরবনের কতটুকু ক্ষতি হয়েছে এবং তা কাটিয়ে উঠতে ভবিষ্যতে কি করতে হবে।’