Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

mamun rashidকেবল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ব্যবসায়িক চর্চা বা উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশে বিদ্যমান ইসলামী ব্যাংকিংকে উপেক্ষা করলে তা হবে আমাদের সামষ্টিক বোকামি। এখন দেশে পুরোদস্তুর আটটি ইসলামী ব্যাংক, তিনটি বিদেশী ব্যাংকসহ ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি ব্যাংকসহ ছয়টি ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উইং বা অনুবিভাগ রয়েছে। গুজব আছে, আংশিক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংককে পুরোপুরি ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরের চিন্তা-ভাবনা চলছে। এইচএসবিসি ব্যাংকের ‘আমানাহ’ বা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ‘সাদিক’ ধর্মানুরাগী আমানতকারীদের মধ্যে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে।

এসব ব্যাংকের সর্বসাম্প্রতিক তথ্য না থাকলেও এটা বলা যায়, পুরোদস্তুর আটটি ইসলামী ব্যাংক পুরো ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ১৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। অধিক বিস্ময়ের বিষয় হলো, ব্যাংকিং খাতের ২১ শতাংশ ঋণই আটটি ইসলামী ব্যাংক দেয়। দেশের মোট রেমিট্যান্সের ৩০ শতাংশের অধিক এসব ব্যাংকের মাধ্যমে আসে। অবশ্য এর মধ্যে কেবল সুপরিচিত একটি ব্যাংক— ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মাধ্যমে আসে ২৮ শতাংশ প্রবাসী আয়। এ কয়টি ব্যাংক দেশের ২১ শতাংশ আমদানি ও ২৪ শতাংশ রফতানি বাণিজ্যের লেনদেনের মাধ্যম-প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহূত হয়। বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সদস্যদের যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই তাদের পছন্দের ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের নামই বলবেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে এইসএসবিসি ব্যাংককে বাংলাদেশের কিছু ইসলামী ব্যাংকের হিসাব খোলা-সংক্রান্ত অনিয়মের জন্য শাস্তি প্রদানের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনেক ব্যাংক অথবা বিদেশী ব্যাংকই আলোচ্য ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে ক্রেডিট লাইন বা করেসপনডেন্ট ব্যাংকিং সুবিধা প্রত্যাহার করার পরও বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্যের একটি বিরাট অংশ পরিচালিত হয় ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। তাই এ সমস্যা না থাকলে এর আকার হয়তো মহীরুহ পর্যায়ে পৌঁছত।

chardike-ad

কেউ যদি চিন্তা করে থাকেন আজকাল সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের পরিবর্তে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের প্রতি সাধারণ মানুষ কিংবা অধিকসংখ্যক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকছে, তা সম্ভবত ঠিক নয়। বরং আমি মনে করি, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মানবসম্পদ, সেবার মান ও সর্বোপরি গ্রাহকের বিপদ-আপদে ব্যাংকগুলোর সহযোগিতার ইচ্ছা ও সার্বিক সামর্থ্যই এসব শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকে সাধারণ মানুষের ঝোঁকার কারণ। এছাড়া তাদের প্রদেয় প্রডাক্ট অধিক সুরক্ষিত ও গ্রাহকবান্ধব। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এসব ব্যাংক তাদের ঋণ সুবিধার ২০ শতাংশ শিল্প খাতে, ২৬ শতাংশ ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং প্রায় ২৩ শতাংশ পরিবহন খাতে সম্প্রসারণ করেছে।

সাব-প্রাইম ক্রাইসিসের সময় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অধিক সিনথেটিক সলিউশন সৃষ্টির বিপরীতে কল্যাণধর্মী ব্যাংকিং সেবা প্রবর্তনে ইসলামী ব্যাংকিং উন্নত বিশ্বেও লক্ষণীয় গুরুত্ব্ব অর্জন করেছে। মধ্য-নব্বইয়ে ইসলামী ব্যাংকের মোট সম্পদ কেবল ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও ২০১৩ সালে তা ব্যাপকভাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারে। এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও সিটিব্যাংকের মতো বৈশ্বিক ব্যাংকগুলো বিদ্যমান ইসলামী ব্যাংকিং অফার/প্রডাক্টগুলো পুনর্বিন্যাস অথবা বন্ডসহ শরিয়াভিত্তিক অর্থবাজারের অন্যান্য প্রডাক্ট প্রবর্তনে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা শরিয়াভিত্তিক হেজিং প্রডাক্টগুলো চালু করতেও দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। নিকট অতীতে অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন ভারতে ইসলামী ব্যাংকের সম্ভাবনা পর্যালোচনা করে সরকারকে কিছু সুপারিশও দিয়েছেন। ভারতীয় সরকার তার সুপারিশের কিছু বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেখানে ওই খাত সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। পাকিস্তানসহ অনেক দেশই বাজারে সুকুক বা ইসলামী বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে বৃহত্ প্রকল্প অর্থায়ন করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু প্রয়োজনীয় অথচ নতুন নীতিমালা জারির সুবাদে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং বেশ গতি লাভ করেছে। ২০০৯ সালের ইসলামী ব্যাংকিং নীতিমালা, ইসলামী ইনভেস্টমেন্ট বন্ড, শরিয়া কমপ্লায়েন্ট রিফিন্যান্সিং স্কিম, ইসলামী ব্যাংকের জন্য আলাদা পরিদর্শন দল গঠন, ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণে অধিক সহযোগিতা প্রদান, অধিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কল্যাণের দিকে অব্যাহত নজর খাতটির দ্রুত বিকাশ ত্বরান্বিত করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত পাঁচ বছরে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে ২৬ শতাংশ আর ঋণ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও সম্পদের বর্ধিষ্ণু অংশ নিয়ে এটা আরো দ্রুত সম্প্রসারণ হতে পারে।

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ব্যাপকতর বিকাশে আমরা কী করব? প্রথমে মালয়েশিয়ার মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শরিয়াহ বোর্ড ঢেলে সাজাতে হবে এবং এর টার্মস অব রেফারেন্স নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রদেয় প্রডাক্ট সম্পর্কে উত্তম দৃশ্যমানতা জারি রাখা, অব্যাহত প্রডাক্ট উন্নয়ন প্রচেষ্টা, বিপন্ন ঋণ সম্পদের ওপর ব্যাপক তদারকি এবং কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ ইসলামী ব্যাংকিংকে আরো মর্যাদাপূর্ণভাবে লাভে সাহায্য করবে।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা গ্রাহক পর্যায়ে হস্তক্ষেপ-সক্ষমতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং অ্যাপ্রোচ এবং ধর্মীয় ও কল্যাণমূলক প্রণোদনার কারণে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডে তরুণ-যুবকসহ বিপুলসংখ্যক গ্রাহক আকর্ষণ করতে পেরেছে। অভিযোগ রয়েছে ওই ব্যাংকের অনেক কর্মী একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থেকে এসেছেন। তবে তাদের নেতৃত্ব পর্যায়ে মূলধারার ব্যাংকারদের অনেকেরই যোগদান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারি বৃদ্ধির ফলে দৃশ্যপট দ্রুতই পাল্টে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অধিক স্বচ্ছতা আনয়নে নতুনভাবে নজর দিয়েছে। তবে এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর রাজস্ব বা আয় অর্জনের মডেল তথা ঋণ-আমানতের রিটার্ন বা সেবার মাশুল কিংবা হার আরো পর্যালোচনা ও নজরদারি প্রয়োজন। প্রয়োজন ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে আরো নিরীক্ষা ও পর্যালোচনামূলক বৈঠক। এ ব্যাপারে আমরা মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এমনকি যুক্তরাজ্য থেকেও অনেক সহায়তা পেতে পারি। যুক্তরাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংকিং তথা ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইদানীং অধিকতর আগ্রহ দেখাচ্ছে।

কল্যাণ ও গ্রাহককেন্দ্রিক মডেলের কারণে অনেক ঋণগ্রহীতা ও আমানতকারী ইসলামী ব্যাংকিং পছন্দ করলেও একজন গ্রাহকের আমানতের বিপরীতে মুনাফা কত দেয় অথবা ঋণগ্রহীতা বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে কত চার্জ নেয়, তা নিয়ে এখনো অনেকের মধ্যে সংশয় আছে। তাই ইসলামী ব্যাংকিংয়ে প্রদত্ত কমিশন ও ফি আদায় মডেল পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। আবার এ ধরনের ব্যাংক সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন কিংবা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট গ্রুপকে সুফল প্রদানের সম্ভাব্য সন্দেহ থেকেও মুক্ত নয়। সামগ্রিক বিচারে ইসলামী ব্যাংকিং অপারেশন, প্রডাক্ট অফারিং, সুশাসন ও রাজস্ব আয় কাঠামোর আরো মান নিশ্চিতে অধিক দৃষ্টি দেয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং উন্নয়ন অংশীদারদের এখনই সময়। অন্যদিকে আবার অবিবেচকের মতো বা অন্যায়ভাবে তাদের চাপাচাপি করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যও।

লেখক: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

বণিকবার্তার সৌজন্যে।