সরকার যেদিন থেকে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াবে, সেদিন থেকেই সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরুর হুঁশিয়ারি দিলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, ‘স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, তেল , গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যাবেনা, বরং কমাতে হবে। মূল্যবৃদ্ধি হলে কঠিন কর্মসূচি দেওয়া হবে।’ সেই কর্মসূচি পালনের জন্য দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর বালুর মাঠে স্থানীয় ২০ দলীয় জোট আয়োজিত এক জনসভায় তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন। ‘বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চক্রান্ত প্রতিরোধ, গুম-খুন গুপ্তহত্যা বন্ধ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন’ দাবিতে স্থানীয় ২০ দলীয় জোট এই জনসভার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকার।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘সরকার কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। কুইক রেন্টালের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। এখন আবারো দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি করা হলে মানুষ বিদ্যুতের দাম দেবে, নাকি ভাত খাবে? তারা (সরকার) দাবি করে, ১০ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। বাস্তবে তা ৬ হাজার মেগাওয়াট।
তিনি বলেন, ‘গ্যাসেও দূরাবস্থা চলছে। গুলশানের মতো জায়গায় এখন গ্যাস ভালোমত পাওয়া যায় না। গ্যাসের অভাবে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও এই সরকার তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার মূল আসামিকে আড়ালে রাখা হয়েছে অভিযোগ করে বিএনপি চেয়াপারসন বলেন, ‘এই ঘটনার আসল হোতা কর্নেল জিয়া। তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। তাকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? সরকার তাকে ধরার সাহস পায়নি। কারন তাকে ধরলে শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, বাংলাদেশের সব খুনের ঘটনা বেরিয়ে আসবে।’
উল্লেখ্য, সম্প্রতি লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাকে দায়ী করে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে র্যাব।
এদের মধ্যে ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ ও কোম্পানি কমান্ডার আরিফ নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়রসহ সাতজনকে অপহরণ থেকে শুরু করে শীতলক্ষ্যায় লাশ ডুবানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। আর রানা অপহরণে অংশ নিয়ে ঘটনায় আংশিক জড়িত ছিলেন বলে র্যাবের এই অভ্যন্তরীণ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এই তিনজনসহ র্যাবের মোট ২১ সদস্যের নাম এসেছে প্রতিবেদনে- যারা কোনো না কোনোভাবে হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে র্যাব মনে করছে।
আর নারায়ণগঞ্জের দুই আওয়ামী লীগ নেতা সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও কাউন্সিলর নূর হোসেনের দ্বন্দ্বকেই এ হত্যাকান্ডের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্র্রতিবেদনে।
এ ঘটনার প্রসঙ্গে টেনে খালেদা জিয়া বলেন, ‘লোক দেখানোর’ জন্য যাদের ধরা হয়েছে, জেলখানায় তাদের জামাই আদরে রাখা হয়েছে। এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও তাদের লোক জড়িত। ওই সময়ে ৭ জন নয়, ১১ জনকে খুন করা হয়েছে বলেও দাবি করেন খালেদা।
কর্নেল জিয়াকে চাকরিচ্যুত করার দাবি জানিয়ে খালেদা জিয়া আরো বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে বৈঠক করলে যদি চাকরিচ্যুত করা হয়, তবে সে (কর্নেল জিয়া) কীভাবে চাকরিতে থাকে? তাকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
সুন্দরবনে তেল ট্যাংকারডুবির ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ দাবি করে এ জন্যও আওয়ামী লীগকে দায়ী করেন প্রাক্তন এই প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সুন্দরবন ধ্বংসের চক্রান্ত হচ্ছে। এ জন্য তেল ফেলে জীববৈচিত্র নষ্ট করে সুন্দরবন ধ্বংসের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তারা (আওয়ামী লীগ) মানুষ খেকো নয়, এখন বাংলাদেশ খেকো। তারা দেশকে খেয়ে ফেলবে।’
আওয়ামী লীগ দেশকে ধ্বংস করছে- অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবৈধ- জুলুমবাজ সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামতে হবে। তাহলেই দেশে উন্নয়ন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ধর্মকর্ম করার স্বধীনতা পাওয়া যাবে।’
সরকারের ‘লাঞ্ছনা ও অত্যাচারে’ বিজয়ের মাসেও দেশের জনগণের মনে আনন্দ নেই মন্তব্য করে, বিএনপি প্রধান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দেশে এখন প্রতিনিয়িতই খুন, গুম ও হত্যাকান্ডের মত ঘটনা ঘটাচ্ছে। তারা জনগণের কাছে এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয়করণ করে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দুর্নীতিগ্রস্থ করে তুলেছে। সিভিল প্রশাসনকেও দলীয়করণ করেছে। মেধাবী লোকদের চাকরিচ্যুত কিংবা ওএসডি করে রাখা হচ্ছে।’
তার সঙ্গে বৈঠক করা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যুগ্মসচিব এ কে এম জাহাঙ্গীরকে সরকারের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর দিকে ইঙ্গিত করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ভালো ভালো সরকারি কর্মকর্তাকে বের করে দেওয়া হচ্ছে।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘জাতীয় বেঈমান’ ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ‘বিশ্ব বেহায়া’ আখ্যা দিয়ে তাদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে তরুণ সমাজকে প্রতিবাদী হয়ে রাজপথে নামার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া।
বিএনপিকে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের দল হিসেবে অভিহিত করে বিএনপি প্রধান বলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ নেতারা) মুক্তিযুদ্ধ করেনি। আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন। আর জিয়াউর রহমানের ডাকে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এ কে খন্দকার এবং তাজউদ্দিনের মেয়ে এইসব বিষয় তুলে ধরেছেন।’
১/১১-এর তৎকালীন মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার তারেক রহমান ও কোকোর ওপর নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে তাকে বিদেশ যেতে বাধ্য করতে চেয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তখন বিদেশে যাইনি। বলেছি, বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই, এ দেশেই আমার ঠিকানা। আমি কোনো আঁতাত করিনি। কিন্তু হাসিনা আঁতাত করে ক্ষমতায় এসেছেন, বিদেশ গিয়েছেন।
ভবিষ্যতে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনে সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি প্রধান বলেন, ‘ডাক আসলে মা-ভাই-বোন নিয়ে রাজপথে নেমে পড়বেন। শুধু চোখের পানি মুছলে হবে না। এবার আপনাদের সঙ্গে আমিও নামবো। দেখি, পুলিশ কিভাবে গুলি চালায়…বালুর ট্রাক দিয়ে আটকে রাখে। রাজপথে দেখা হবে।’
দেশবাসীকে উদ্দেশ্য করে বেগম জিয়া বলেন, ‘যে যেখানে আছেন, সেখান থেকে আন্দোলন শুরু করতে হবে। শীত, বর্ষা, গ্রীস্ম নেই, যতদিন প্রয়োজন ততদিন আন্দোলনে থাকতে হবে।’
সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে ‘অপকর্ম’ করাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সব পুলিশ খারাপ না। কিন্তু একটি বিশেষ অঞ্চলের লোক নিজেদের আইনের উর্ধ্বে মনে করে। সরকারকে টিকিয়ে রাখতে তারা যা ইচ্ছে তাই করছে। তারা মনে করে, সব অপকর্ম মাফ পেয়ে যাবে।’
পুলিশ বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আপনারা জনগণের সেবক হয়ে থাকবেন, সেবা করবেন। মানুষের ওপর জুলুম করবেন না, গুলি চালাবেন না। আপনাদেরও মা-ভাই-বোন আছে।’
জনসভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, ছাত্রদলের সভাপতি রাজীব আহসান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা প্রমুখ।
জোট নেতাদের মধ্য জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক মজিবুর রহমান, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, এনডিপির খন্দকার গোলাম মোর্র্তজা, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, মহাসচিব হামিদুল্লাহ আল মেহেদি, মুসলীম লীগের সভপতি এ এইচ এম কামরজ্জামান খান, ডিএলর সাইফুদ্দিন মনি, ইসলামিক পার্টির আবদুল মোবিন, সাম্যবাদী দলের সাঈদ আহমেদ, পিপলস লীগের এ্যাড মাঈদ মাহবুব, জমিয়তে উলামা ইসলামের মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম, মুসলীগ লীগের শেখ জুলফিকুর আলী চৌধুরী।
বিএনপির চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে দেশব্যাপি ধারাবাহিক সফরের অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে এ জনসভায় বক্তব্য রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গণসংযোগের অংশ হিসেবে এর আগে রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, জয়পুরহাট, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, জামালপুর, নীলফামারী, নাটোর, কিশোরগঞ্জ ও কুমিল্লায় জনসভা করেন তিনি।