শুধু জনসেবার জন্য ফেসবুক তৈরি করেননি মার্ক জাকারবার্গ। ফেসবুক ব্যবহারের খরচ হিসেবে আপনি ফেসবুককে যে তথ্য দেন তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে পারে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই যৎসামান্য তথ্য দিয়ে কী আর ফেসবুকের দাম চুকানো যায়?
ফেসবুকের মতো এত বড় একটি সাইট চালানোর খরচের কথা একবার ভাবুন তো! ফেসবুক কিন্তু আপনি বিনা পয়সায় ব্যবহার করে যাচ্ছেন। কিন্তু বিনা মূল্যের এই সেবা চালিয়ে যাওয়ার এবং নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্যও একটি চমৎকার পথ খুলে রেখেছে ফেসবুক। কীভাবে বিনা পয়সায় সেবা দিয়ে যাচ্ছে ফেসবুক? টেলিগ্রাফ অনলাইনের এক সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে সেই তথ্য।
ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। অনেকেই এখন ফেসবুকে দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছেন। ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের বিভিন্ন বিষয় ফেসবুকে শেয়ার করে চলেছেন অনেকেই। তাই ফেসবুকের ব্যবহারের নীতিমালায় সামান্যতম পরিবর্তন এলেও তা এখন বড় বিষয়। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবহারবিধিতে সম্প্রতি একটি পরিবর্তন এনেছে, যা ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। ফেসবুকের ব্যবহারবিধির এই পরিবর্তন এখন অনেকেরই মনোযোগ কেড়েছে।
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেসবুকের ব্যবহারকারীর কাছ থেকে কী তথ্য সংগ্রহ করা হয় বা তা কী কাজে লাগানো হয় তা নিয়ে এখন অনেকেই সচেতন। আমরা অনেকেই ধারণা করে বসি যে ফেসবুক জনসাধারণের জন্য তৈরি বিনা মূল্যের একটি সেবা। এর কারণ হচ্ছে আমরা অনেকেই বিনা খরচায় ফেসবুক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছি এবং সামাজিক যোগাযোগের কার্যকর উপাদান হিসেবে মানিয়ে নিয়েছি। এ কারণেই আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে ফেসবুক একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেখানে অনেক শেয়ারহোল্ডার আছেন, যাঁরা ফেসবুক থেকে লাভ তুলে নেওয়ার জন্য দিনরাত হাঁ করে বসে আছেন।
এত বেশি ব্যবহারকারীর একটি সাইট চালানোর খরচটাও একেবারে কম নয়। আমরা ফেসবুকের এত ফিচারের জন্য একটাও পয়সা দিই না। অথচ চমৎকার নকশার নির্ভরযোগ্য সেবা আমরা ফেসবুকের কাছ থেকে পাচ্ছি, যার মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ করছি, তর্ক-বিতর্ক করছি এবং লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে আলোচনা করছি, কনটেন্ট শেয়ার করছি ও ছবি-ভিডিও দেখছি। সবগুলোই চমৎকার সেবা। আর এসব সেবাই কিন্তু বিনা পয়সার!
কিন্তু আসলেই কী তাই? আমাদের ফেসবুকে দেওয়া সব ধরনের কনটেন্ট রাখতে এবং চাওয়া মাত্রই হাজির করতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে হাজার হাজার সার্ভার বসাতে হয়েছে, অর্থ খরচ করতে হয়েছে। ফেসবুকে দক্ষ প্রকৌশলীরা আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি করছেন। ফেসবুক সব সময় চালু রাখতে, উন্নত সেবা দিতে সেখানে আছেন প্রোগ্রামার, সফটওয়্যার প্রকৌশলীরা। তাঁদের বেতন-ভাতার কথাও ভাবুন। এ ছাড়া এত বড় মানুষের নেটওয়ার্ক হিসেবে ফেসবুকের কিছু সামাজিক ও আইনগত দায়বদ্ধতাও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অবৈধ কনটেন্ট সরিয়ে ফেলা। এ জন্য আইনজীবী ও নীতিনির্ধারক দলকেও পুষতে হচ্ছে ফেসবুককে।
ঠিক এ কারণেই ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে যত পারে তত তথ্য চাইছে। আর এটাই ব্যবহারকারীর সঙ্গে ফেসবুকের চুক্তি। বলা হয় যে, আপনি যদি অর্থ না দিয়ে কিছু পান, তখন আপনাকেই পণ্য হিসেবে ধরা হয় এবং আপনার তথ্য সেই দাম পরিশোধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফেসবুকের ব্যবসার মডেল হচ্ছে আমাদের ফেসবুকে শেয়ার করা বিভিন্ন তথ্যের বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেখানো। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করা।
অনেকেই ফেসবুকের এই নীতিতে সন্তুষ্ট আবার অনেকেই তাঁদের ব্যক্তিগত কারণে ফেসবুকের নীতিমালার সঙ্গে সন্তুষ্ট হতে পারেন না। তখন তাঁদের পক্ষে ফেসবুকের সঙ্গে চুক্তি করার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিনা মূল্যে ফেসবুক ব্যবহার করতে হলে ফেসবুকের সঙ্গে চুক্তিতে যেতেই হবে। এখানেই ফেসবুক ব্যবহারের নীতিমালার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবহার বিধিমালা এখন আমাদের অনেকের জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে। কিন্তু দেখা যায়, এ ধরনের নীতিমালার বিষয়গুলো আমরা এড়িয়ে যেতেই পছন্দ করি। আমরা যখনই কোনো ইন্টারনেট সংযোগযুক্ত যন্ত্র ব্যবহার করি বা কোনো ওয়েবসাইটে যাই, তখন আমাদের একটি বড় আকারের শর্ত মেনে নিতে হয় বা ব্যবহারবিধিতে সম্মতি দিতে হয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক মানুষ আছেন, যাঁরা সাইন আপ করার সময় এত দীর্ঘ নীতিমালা পড়ে দেখেন। এসব সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আড়ালে আইনজীবীদের তৈরি নানা রকম শর্ত জুড়ে দেওয়া থাকে। আমরা শুধু রাজি হয়ে ক্লিক করে বসি এবং খারাপ কিছু ঘটবে না সে আশাই করে থাকি।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, আমরা যখনই যে ধরনের চুক্তিতে সম্মতি দিই না কেন তা একটু হলেও খেয়াল করে দেখা উচিত।
ফেসবুক ফ্রি-ই থাকছে
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গুজব ছড়িয়েছে যে, ফেসবুক ব্যবহারের ওপর মাসিক চার্জ বসতে যাচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্রূপাত্মক ওয়েবসাইট ন্যাশনাল রিপোর্ট ফেসবুক নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, নভেম্বর থেকে ফেসবুক ব্যবহারে মাসিক ২.৯৯ মার্কিন ডলার করে খরচ করতে হবে। ন্যাশনাল রিপোর্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সম্প্রতি ফেসবুক একটি সংবাদ সম্মেলন করেছে, যেখানে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রতি মাসের খরচ নির্ধারণ করেছে। মাসে ২.৯৯ ডলার করে ফি দিয়ে তবেই ফেসবুক ব্যবহার করা যাবে।’
ন্যাশনাল রিপোর্টের ওই প্রতিবেদনে জাকারবার্গের বানোয়াট উদ্ধৃতিও ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, ‘ফেসবুক ব্যবহারের ওপর চার্জ বসানোর বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ ও ভালোভাবে চিন্তা করে দেখেছি এবং শেষ পর্যন্ত চার্জ বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের এখনকার খরচ যেভাবে বেড়েছে তা মেটাতে আমরা যদি কোনো ব্যবস্থা না নিই, ভবিষ্যতে ফেসবুকের অস্তিত্ব থাকবে না।’
কিন্তু বরাবরের মতোই ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ধরনের গুজবে কান দেবেন না। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বিনা মূল্যেই সেবা দিয়ে যাবে কর্তৃপক্ষ। এর জন্য কোনো ফি দিতে হবে না।
সূত্রঃ প্রথম আলো