একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জাপানের গণমাধ্যমে দুটি শব্দ ‘নিউ পুওর’ ও ‘ওয়ার্কিং পুওর’-এর প্রচলন শুরু হয়। সাধারণত যেসব নাগরিক এক বা একাধিক চাকরি থাকা সত্ত্বেও সচ্ছল জীবনযাপনে ব্যর্থ, তাদেরকে উদ্দেশ করেই এ শব্দ দুটো প্রয়োগ করা হতো। একপর্যায়ে ‘পুওর’ শব্দটির প্রচলিত অর্থ বেশ গৌণ হয়ে পড়ে এবং তার জায়গায় স্থান নেয় ‘হিনকন’, যার অর্থ দারিদ্র্য। জাপানি ভাষায় হিনকন শব্দটি বেশ গভীর একটি তাত্পর্য বহন করে। তাই প্রশ্ন চলে আসে, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে দারিদ্র্যের সংজ্ঞা আসলে কী?
দারিদ্র্যসীমা দিয়ে শুরু করা যাক। ২০১২ সালে জাপানের দারিদ্র্যসীমা ধরা হয়েছিল ১২ লাখ ২০ হাজার ইয়েন (১০ হাজার মার্কিন ডলার)। সে সময়ে দেশটির গড় গৃহস্থালি আয়ের অর্ধেক ছিল এ দারিদ্র্যসীমা। অর্থনীতিতে ‘আপেক্ষিক দারিদ্র্য’ মানে সমাজে বসবাসরত কোনো নাগরিক যখন ওই সমাজের সচ্ছল জীবনযাত্রার মানদণ্ড অনুসারে পর্যাপ্ত আয় করতে ব্যর্থ হন। এ আপেক্ষিক দারিদ্র্যের হিসেবে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) তালিকায় ১৬ দশমিক ১ শতাংশ গৃহস্থালি পর্যায়ে দারিদ্র্য নিয়ে এটির সদস্য রাষ্ট্রদের মাঝে চতুর্থ অবস্থানে আছে জাপান। শীর্ষে আছে মেক্সিকো (১৮ দশমিক ৫ শতাংশ), তুরস্ক (১৭ দশমিক ৫ শতাংশ) ও যুক্তরাষ্ট্র (১৭ শতাংশ)। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে, ১৯৮৫ সাল থেকে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের পর থেকে ২০১২ সালে শিশু দারিদ্র্যের হার (গড় গৃহস্থালি আয়ের অর্ধেকেরও কম আয় আছে এমন পরিবারের ১৮ বছরের নিচে শিশুরা) ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ প্রথমবারের মতো আপেক্ষিক দারিদ্র্যের হারকে পেছনে ফেলেছে।
বর্তমানে প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে আটটি সরকারের কাছ থেকে কল্যাণ সহযোগিতা পেয়ে থাকে। এদেরকে সাধারণত তিনটি প্রধানতম ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়: বয়স্ক (৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ), সিঙ্গেল মাতা (৭ দশমিক ১ শতাংশ) এবং প্রতিবন্ধী (২৯ দশমিক ৩ শতাংশ)। দেশটির স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত আগস্টে ২১ লাখ ৬৩ হাজার ১৫২ জন ব্যক্তি এ সহযোগিতা পেয়েছেন, যা জানুয়ারিতে ছিল ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৯২৭ জন।
এ কল্যাণ সহযোগিতা নিয়ে অনেক কর্মজীবীর মাঝে অসন্তোষ থাকলেও এ সহায়তা একেবারে অপব্যয় হিসেবে প্রদান করা হচ্ছে না। সহায়তা গ্রহণকারী ৬০ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি টিভিতে সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য আবশ্যকীয় খরচের পেছনে ব্যয় করার পর তিন বেলা খাওয়ার মতো কিছু অর্থ তার হাতে থাকে মাত্র।’
স্থানীয় একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন স্পা অনেক দিন ধরেই এ দারিদ্র্যের ওপর নজর রাখছে এবং বিগত ছয় মাসে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: ‘দ্য লিভিং হেল অব পুওর ফ্যামিলিজ (জুলাই ২২-২৯), দ্য ইমপোভারিশমেন্ট অব ইয়ং পিপল ওন্ট স্টপ (সেপ্টেম্বর ৯) এবং সেভেন ডেডলি সিনস দ্যাট আর দ্য কজ অব নিউ-টাইপ পোভার্টি (নভেম্বর ৪-১১)।’
এ ‘সেভেন ডেডলি সিনস’ বা সাতটি ‘মহাপাপ’ হিসেবে বলা হচ্ছে: ১. অস্থায়ী কর্মী অতিমাত্রায় নিয়োগ, ২. চাকরির পরিবর্তনে আয়ে উল্লেখযোগ্য পতন, ৩. ভুয়া কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধি, ৪. কর্মক্ষেত্র ও চাকরি নিয়ে ক্রমবর্ধমান হতাশা, ৫. বয়স্ক পিতামাতার ভরণপোষণে ব্যয় বেড়ে যাওয়া, ৬. আবাসন বন্ধকি ও ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য বিপুল ঋণ নেয়া এবং ৭. মধ্যবয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি যাদের বিয়ে করার সম্ভাবনা নেই।
আগামী বছরই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তির ৭০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। যুদ্ধের পরে দেশটি এক ভয়াবহ দারিদ্র্যের ছোবলে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রবলভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশের কাতারে চলে আসে। কিন্তু সম্প্রতি দারিদ্র্যের নানা লক্ষণ দেখার পর সমাজবিজ্ঞানী থেকে অর্থনীতিবিদরা এখন গভীর উদ্বেগে সেই পুরনো জাপানি প্রবাদের কথা স্মরণ করছেন, ‘পিতামাতা কঠোর পরিশ্রম করে, ছেলেমেয়েরা আয়েশে খেয়ে যায় আর নাতিপুতিরা ভিক্ষায় নামে।’ তাই সব মহলে প্রশ্ন উঠছে, আবেনমিকস কি পারবে এ প্রবাদের সেই দিনগুলোকে দূরে ঠেকিয়ে রাখতে? জাপান টাইমস থেকে