সময় বদলেছে। এখন আর আজকের খবরের জন্য আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নন অনেকেই। মুহূর্তেই পেতে চান সর্বশেষ খবর। তাই, অনলাইন সাংবাদিকতা এখন সময়ের দাবি।
আগে একটা পত্রিকার জন্য এক সপ্তাহও অপেক্ষা করত মানুষ। সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোও চলত বেশ। কিন্তু এখন দৈনিক পত্রিকাও পুরনো মনে হয়। কারণ, অনলাইন পত্রিকাগুলো প্রতিমুহূর্তেই টাটকা খবর সরবরাহ করছে। তাই, খবর গরম থাকতেই তা জেনে নিচ্ছে উৎসুক পাঠক।
বাংলাদেশেও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, বাড়ছে অনলাইন পত্রিকার সংখ্যাও। দিনে দিনে মানুষের নেট অ্যাকসেস বাড়ছে। মোবাইল ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে খবর পড়ার সুবিধা।অনলাইন পত্রিকাগুলোর পাঠক বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে।
ফলে অমুক ডটকম, তমুক ডটকম নাম নিয়ে আসছে নতুন নতুন অনলাইন পত্রিকা। আর অবধারিতভাবেই বাড়ছে প্রতিযোগিতাও। ডটকমের নামে ডটের ছড়াছড়ি। ডট কম তো নয়, বরং ডট বেশিই হচ্ছে।
কে কার আগে নিউজ দিতে পারে, এর প্রতিযোগিতা চলছে। যেন, টাইমলিনেসই একমাত্র সংবাদ-যোগ্যতা। সংবাদে কতটা অ্যাকুরেসি থাকল, এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই অনেকেরই। এমনও হয়েছে, দুর্ঘটনার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নিউজ দেওয়া শেষ। শিরোনাম ‘অমুক কারখানায় আগুন লেগে নিহত ১০’। পরে দেখা গেল- আসলে মারা গেছে ৭। পরক্ষণেই শিরোনামে পরিবর্তন ‘অমুক কারখানায় অগ্নিকা-ে নিহত ৭’। যেন, মরে যাওয়ার পর ৩ জন জীবিত হয়েছেন।
তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নানারকম ভুল তথ্য পরিবেশনের ভুরিভুরি নজির পাবেন একটু খেয়াল করলেই। জলদি নিউজ দিতে গিয়ে ভুল উদ্ধৃতি বা তথ্য বিকৃতিও ঘটছে। তথ্য যাচাইয়ের সময় নেই। গুজবের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হচ্ছে অনেক নিউজ।এসব প্রবণতা সাংবাদিকতার নীতির সঙ্গে পুরোই সাংঘর্ষিক।
টাইমলিনেস সংবাদ হয়ে ওঠার একটা যোগ্যতা, জানি। কিন্তু এর চেয়ে অ্যাকুরেসি যে আরো বড় যোগ্যতা, সেটা যেন ভুলেই যাচ্ছি আমরা।
আরেকটি বড় প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। পাঠক বাড়াতে তথ্য পরিবেশনের চেয়ে সুড়সুড়ি দেওয়াতেই বেশি মনোযোগী সংবাদ কারিগররা। অ্যালেক্সা র্যাঙ্কিংয়ে ওপরে ওঠাকেই যখন একমাত্র সফলতা মনে করা হয়, তখন পাঠকের সংখ্যা বিবেচনা করা হয়, তার রুচি নয়। হিসেব করা হয়, কতজন ভিজিটর আমার সাইট ভিজিট করলেন। কোন শ্রেণির বা কেমন রুচির পাঠক আমার সাইটে সংবাদ পড়লেন, সেটা তখন আর বিবেচনার মধ্যে থাকে না।
এ ধরনের সুড়সুড়ি জাগানিয়া সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করা হয় নিয়মিতই। এমনকি তা প্রচ্ছদে বা সাইটের সবচেয়ে দৃশ্যমান অংশে স্থান পায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুর চেয়ে সানি লিয়ন, পুনম পান্ডে বা শারলিন চোপড়ার নিউজ ছাপা হয় ফলাও করে। সঙ্গে থাকে উত্তেজক ছবি বা ভিডিও। যদিও অনেক সময়ই এসবের সংবাদ-যোগ্যতা খুব বেশি থাকে না।
বিনোদন সংবাদের প্রতি পাঠকদের আগ্রহ আছে, মানি। তাই বলে রসিয়ে রসিয়ে স্ক্যান্ডাল-নির্ভর রগরগে সংবাদ পরিবেশন বিনোদন সাংবাদিকতার মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। শিল্প-সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে তো হাজারো প্রতিবেদন লেখা সম্ভব। এ দিকে মনোযোগ যেন দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, খেলোয়ারের মাঠের পারফরমেন্সের চেয়ে ঘরের পারফরমেন্সের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার দিকে আজকালকার অনেক অনলাইনের বিশেষ ঝোঁক লক্ষ্যণীয়। বিরাট কোহলির রেকর্ড নিয়ে দুইশ’ শব্দের স্টোরিও হয় না অনেক নিউজ পোর্টালে। কিন্তু আনুশকা শর্মার সঙ্গে তার অভিসারের তথ্য আর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের আপত্তিকর (ছাপানোর অযোগ্য) ছবি নিয়ে তৈরি হয় বিশেষ প্রতিবেদন। মারিয়া শারাপোভার অসাধারণ কৃতিত্বের চেয়ে তার সংক্ষিপ্ত পোশাকই যখন খবর হয়ে যায়, তখন সেটা আর খেলার সংবাদ থাকে কি?
হ্যাঁ, ‘পারসনাল ইমপ্যাক্ট’ বলে একটা সংবাদ উপাদান আছে। তারকা ব্যক্তিত্বদের ছোট ঘটনাও সংবাদ হয়। তার মানে এই নয় যে, তাদের কৃতিত্বের চেয়ে তাদের একান্ত ব্যক্তিজীবনই বড় হয়ে উঠবে। আর দশটা মানুষের মতো তারকাদেরও গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার আছে, সেটা ফাঁস করে তাদের হেয় করা কোন ধরনের সাংবাদিকতা?
‘সহবাসের ১০টি উপকারিতা’, ‘সঙ্গমের ২০টি উপায়’, ‘অসতী নারী চিনবেন কীভাবে,’- এ রকম লেখা অনলাইন পত্রিকাগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়। অবশ্য, এর একটা কারণ আছে। হিসেব করলে দেখা যাবে বাংলাদেশে যারা অনলাইনে সংবাদ পড়েন তাদের অধিকাংশই তরুণ। তাদের বয়স গড়ে ত্রিশ বছরের মতো হবে। এই বয়সী পাঠকদের টানতে নীতি-নৈতিকতাকে নির্বাসনে পাঠাতে একটুও দ্বিধা নেই অনলাইনওয়ালাদের।
এবার একটু ভেবে দেখি তো..। এই যে সুড়সুড়ি দিয়ে পাঠক টানছি, সেটা কি সাংবাদিকতা হচ্ছে? ফুটপাতে সর্বাধিক বিক্রিত ‘রসময় গুপ্ত রচিত চটি’র সঙ্গে এর ফারাকটা থাকছে কোথায়? এসব চটিকে যদি আমরা সংবাদ মাধ্যম মনে না করি, তাহলে চটির অনলাইন ভারসন সংবাদ মাধ্যম হয় কীভাবে?
যারা সুড়সুড়ি পছন্দ করেন কিংবা উল্লিখিত ‘উপকারিতা’ ও ‘উপায়’ জানতে চান, তাদের জন্য নানা রকমের চটি আছে; সংবাদ মাধ্যমকে চটি না বানালে নয় কি?
লেখক : রফিক মুয়াজ্জিন (সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী), সৌজন্যেঃ রাইজিংবিডি