একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেলেও পার পেলেন না সংগঠনটির আরেক নেতা কামারুজ্জামান।
সংগঠনটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার পর এবার আপিল বিভাগের রায়ে আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানেরও ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখা হলো। এর মধ্য দিয়ে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কাদের মোল্লার পরিণতিই হতে যাচ্ছে কামারুজ্জামানেরও।
সোমবার সকাল ৯ টা ৮ মিনিটে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। বেঞ্চের অপর তিন বিচারপতি হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত ৩ নম্বর অভিযোগ সোহাগপুরে গণহত্যার দায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে তার মৃত্যদণ্ড বহাল রাখা হয়।
এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আপিলের তৃতীয় চূড়ান্ত রায়। এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন আপিল বিভাগ।
এছাড়া গত বছরের ১২ ডিসেম্বর রাতে আপিলের রায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এদিকে কামারুজ্জামানের রায়ের পর রিভিউ আবেদন নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘দেশে সুনামি হয়নি। সংবিধানও পরিবর্তন হয়নি। অতএব রিভিউ এর সুযোগ আছে। আমরা রিভিউ করবো।’
অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে রিভিউ এর যে কথা বলা আছে তা কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তার মতে, এটি বিশেষ আদালতের রায় হওয়ায় কামারুজ্জামান এই সুযোগ পাবেন না।’
এর আগে নানা নাটকীয়তার পর গত ১২ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়। ১০ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার সব প্রস্তুতি নিলেও সেদিন তা কার্যকর হয়নি।
কাদের মোল্লার আইনজীবীরা অ্যাটর্নি জেনারেলকে না জানিয়েই সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কাছে ফাঁসি কার্যকর স্থগিতের আবেদন জানান৷ চেম্বার জজ তাদের আবেদন গ্রহণ করে পরদিন ১১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর স্থগিত করেন৷ ১১ ডিসেম্বর সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি স্থগিতের আদেশ দেন আদালত৷
পরে ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার আবেদন খারিজ হলে ফাঁসির পথে সব বাধা সরে যায়৷ প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে বিচারপতি এস কে সিনহা, আবদুল ওয়াহাব মিয়া, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং এই এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই আদেশ দেন৷ ওই দিন রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের প্রায় ১১ মাসের মাথায় সোমবার আপিলের রায়ে ফাঁসি বহাল রাখা হলো জামায়াতের আরেক নেতা কামারুজ্জামানের।
২০১৩ সালের ৯ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
এর আগে জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায়ের পর সারাদেশে জামায়াত শিবিরের কর্মীরা ব্যাপক বিক্ষোভ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। জামায়াত নেতা হলেও একজন মোফাচ্ছেরে কোরআন হিসেবে জামায়াত করেন না অথচ সাঈদীর ভক্ত রয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামবাংলা থেকে শহর এমনকি বিদেশেও। সাঈদীর এমন জনসমর্থনে তাকে ফাঁসি দেয়া হলেও সরকারের পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না বলে এমন অভিযোগ ওঠে। পক্ষান্তরে জামায়াতের অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায় হলেও জামায়াত ও শিবিরের কর্মীরা আগের মত তেমন প্রতিবাদ বিক্ষোভ গড়ে তুলতে না পারায় আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়ে যায়। হরতাল ঘোষণা এবং শত শত জামায়াত শিবিরের কর্মী আটক হলেও এতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মত জনসমর্থনে বেশ ঘাটতি রয়েছে। এমনটি মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।