সৌদি আরবের মক্কায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচ প্রবাসীর নিজ নিজ বাড়িতে চলছে আহাজারি।
বুধবার সকালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচ বাংলাদেশির সবার বাড়ি কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও, জালালাবাদ এবং চৌফলদন্ডী ইউনিয়নে।
দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার পরই নিহতদের নিজ বাড়ি কক্সবাজার সদর উপজেলার বৃহত্তর ঈদগাঁও এলাকার নিভৃত পল্লিতে যেন কান্নার রোল। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তারা দিশেহারা।
ঈদগাঁও ইউনিয়নের দক্ষিণ মাইজপাড়ার মনজুর আলম। তিন মেয়ে এক ছেলের টানাপোড়নের সংসার। ছেলে মেয়ের লেখাপড়া শিখিয়ে উন্নত জীবন গড়ার আশায় জমি বিক্রি এবং ঋণ করে গত বছর সৌদি আরবে যান। কাজ নেয় কনষ্ট্রাকশন ফার্মে। কাজে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মনজুরের মৃত্যু তার পরিবারে নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা। বাবাকে হারিয়ে নির্বাক তার বড় ছেলে শওকত।
নিহত মনজুর আলমের স্ত্রী জোহরা খাতুন বলেন, ‘১৯ অক্টোবর ফোন করে পরিবারের সবাই ভালো আছে কিনা জিজ্ঞাসা করে। পরে পরিবারের খরচের জন্য ১৬ হাজার টাকা পাঠিয়েছে বলে ফোন রেখে দেয়। এই ছিল স্বামী মনজুর আলমের সঙ্গে শেষ কথা। এখন আমি ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাবে?’
একই অবস্থা জালালাবাদ ইউনিয়নের মৃত ইদ্রিসের ছেলে মোহাম্মদ আইয়ুবের পরিবারে। যে গাড়িটি দুর্ঘটনায় কবলিত সে গাড়ির চালক ছিলেন আইয়ুব। ১৬ বছর আগে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। বিয়েও করেছেন সেখানে এক প্রবাসী বাঙালির মেয়েকে। দুইদিন আগে মায়ের জন্য ১৬ হাজার পাঠিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন এক মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু ১৬ বছর আগে প্রবাসে গিয়ে একবারও দেশে আসা হলো না তার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ প্রায় তার মা। ১৬ বছর পর তার মৃত সন্তানের মুখ দেখতে তার লাশ বাংলাদেশে নিয়ে আসার দাবি তার।
নিহত আইয়ুবের ছোট ভাই মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আইয়ুব সবার বড়। গত ১৬ বছর ধরে সৌদি আরব রয়েছে। একটি জায়গা ক্রয় করে ঘর তৈরিও শুরু করেছিল। সৌদি আবর থেকে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে দেশে ফেরার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু লাশ হলেও যাতে ফিরে দেওয়া হয় এ দাবি পরিবারের সবার।
দুর্ঘটনায় নিহত ঈদগাঁও মাইজপাড়ার মিয়া হোসেনের ছেলে নাজির হোসেন। চার বছর আগে সৌদি আরব যান।
নিহত নাজির হোসেনের মা মমতাজ খাতুন বলেন, নাজির হোসেনের আরেক ভাই খোরশেদ আলম ১০ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় সৌদি আরবে মারা গিয়েছিলেন। ছোট ভাই নাজির হোসেন এ বছরের শেষের দিকে বিয়ে করার জন্য বাড়িতে আসার পরিকল্পনা করেছিল। তার বড় ভাইয়ের লাশ মক্কায় দাফন করা হয়েছিল। তাই নাজির হোসেনের লাশ ও পবিত্র মক্কা নগরীতে বড় ভাইয়ের কবরের পাশে দাফন করার আকুতি তার।
প্রিয়তম স্বামী মোহাম্মদ আলমকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ স্ত্রী সাবিনা বেগম। দুই বছরের ছেলে রামিম আর আট মাসের গর্ভের সন্তান নিয়ে সেও অনিশ্চয়তায়। মাত্র একমাস আগে ছুটি শেষে সৌদি আরবে ফিরে গিয়েছিলেন মৃত আমির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ আলম। ১৭ বছর ধরে সৌদি আরবে থেকে ভাল আয় রোজগার তার। নতুন বাড়ি করার জন্য ভিটেও নিয়েছিলেন।
নিহত মোহাম্মদ আলম এর স্ত্রী সাবিনা বেগম বলেন, ‘স্বামীকে হারিয়েছি। এখন সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাব জানিনা। শুধু একটা দাবি, যাতে স্বামী মুখটা শেষ বারের মতো দেখতে পারি।’
এদিকে সৌদি আরবে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত অন্যজন চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের পুকুরিয়া ঘোনা গ্রামের মনছুর আলী। এ দুর্ঘটনায় আহত হয় পার্শ¦বর্তী পোকখালী ইউনিয়নের ফজল করিমের ছেলে মোহাম্মদ ইসলাম ও নুরুল আজিমের ছেলে জয়নাল। দুর্ঘটনায় নিহতরা সকলেই পাশাপাশি ইউনিয়নের হওয়ার নিজ নিজ গ্রামের বাসিন্দারাও যেন স্বজন হারাদের সঙ্গে শোকাহত।
কক্সবাজার জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রমিয়ন কান্তি দাশ জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচজন প্রবাসীর মধ্যে দুইজনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং নিহতদের লাশ দাফনের মতামতের জন্য নেওয়া হয়েছে। অপর তিনজনের তথ্য সংগ্রহ এবং পরিবারের মতামত নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাটানো হবে।
প্রসঙ্গত, বুধবার সৌদি আরবের মক্কার জাবলুস-সুর নামক স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা পাঁচ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে।