থাইল্যান্ড উপকূলে যেন মানুষ কেনাবেচার হাট বসেছে। কক্সবাজার উপকূল দিয়ে যেসব বাংলাদেশি অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার পথে যাত্রা করছেন, তাঁদের অনেকেই সেখানে বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন। সেখানকার দালালেরা যাত্রীদের কাউকে কাউকে আটকে রেখে অত্যাচার-নির্যাতন করে টাকাও আদায় করছেন।
সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় গিয়ে দেশে ফিরে আসা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তাঁরা জানান, নির্যাতনের মুখে যাঁরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা পরিশোধ করেন, তাঁদের স্থলপথে (মোটরসাইকেলে) মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়। টাকা দিতে না পারলে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কিন্তু যাঁরা মালয়েশিয়া পৌঁছেন, তাঁদের চাকরি জোটে দুর্গম কোনো জঙ্গলে। যেখান থেকে সহজে ফিরে আসা কঠিন।
ফিরে আসা যাত্রীদের বর্ণনা: ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট। একটি ট্রলারে মালয়েশিয়া রওনা দেন টেকনাফ পৌরসভার ইসলামাবাদ গ্রামের আবদুর রহমান (২৮)। ট্রলারে ছিলেন টেকনাফ, কক্সবাজার, খুলনা, নোয়াখালী ও মিয়ানমারের ১৬৭ যাত্রী। টেকনাফ উপকূল থেকে ট্রলারটি সেন্ট মার্টিন হয়ে মিয়ানমার সাগরে প্রবেশ করলে নৌবাহিনীর সদস্যরা গুলি ছোড়ে। তখন ট্রলারটি আবার সেন্ট মার্টিনের কাছাকাছি চলে আসে। টানা আট দিন এখানে অবস্থান করে ট্রলারটি। তত দিনে ট্রলারে মজুত শুকনো খাবার ও পানি শেষ। এরপর যাত্রীরা লবণপানি খেয়ে অসুস্থ হতে থাকেন। ২২ দিন পর নৌবাহিনী চলে গেলে ট্রলারটি থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছায়।
আবদুর রহমান বলেন, থাইল্যান্ডে পৌঁছার পর সে দেশের দালাল চাংকম ও উচেন যাত্রীদের নিয়ে একটি গুদামে আটকে রাখে। তারপর টাকার জন্য তাঁদের মারধর শুরু করে। মারধরে তাঁর একটি হাত ভেঙে যায়। একপর্যায়ে তিনি সেখান থেকে টেকনাফে বাবার কাছে ফোন করে কান্নাকাটি করে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলেন। সাত দিন পর জমি বেচে বাবা টেকনাফের এক দালালের হাতে টাকা তুলে দেন। এরপর তাঁকে মোটরসাইকেলে করে মালয়েশিয়ার আরেক দালাল আয়ুব খানের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। আয়ুব খান তাঁকে দুর্গম জঙ্গলের একটি সয়াবিন তেল উৎপাদনের বাগান ও কারখানায় চাকরি দেয়। বেতন মাসে ৭০০ রিঙ্গিত। এ টাকায় সাত দিনও চলে না।
রহমান বলেন, অতি কষ্টে এক মাস ১৩ দিন চাকরি করার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে একদিন তিনি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন মালয়েশিয়ার এক শহরে। তখন পুলিশ ধরে তাঁকে কারাগারে পাঠায়। এরপর টানা ছয় মাসের কারাভোগ শেষ করে গত ২১ মার্চ বাড়িতে ফিরে আসেন। গত ৬ সেপ্টেম্বর টেকনাফের পল্লানপাড়ায় আবদুর রহমান এ কাহিনি তুলে ধরেন।
আবদুর রহমান জানান, সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় গিয়ে হাজার হাজার মানুষ দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। অনেকে দেশে ফিরতে না পেরে কান্নাকাটি করছেন। আর যাঁরা থাইল্যান্ডে টাকা পরিশোধ করতে পারেন না, তাঁদের ভাগ্য সাগরে ডুবে মরার চেয়েও ভয়াবহ। সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যেতে একজন মানুষের যে টাকা খরচ হয়, সে টাকায় বৈধভাবে দুজন যাওয়া যায়।
টেকনাফে ফিরে আসা ফজলুল হক (৩০) বলেন, দালালেরা তাঁকে নৌকায় তুলে গভীর সমুদ্রে নিয়ে যায়। তারপর থাইল্যান্ডের একটি মালবাহী জাহাজে তুলে দেয়। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস করে আবার থাইল্যান্ড ফিরে যাওয়া ওই জাহাজটিতে ছিল আরও অন্তত দুই হাজার যাত্রী। জাহাজটি তিন দিন পর থাইল্যান্ড উপকূলে পৌঁছালে দালালেরা নৌকায় তুলে যাত্রীদের নিয়ে যায়। তারপর নানা কৌশলে চলে টাকা আদায়ের খেলা। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার আর বাংলাদেশ মিলে দালালদের শক্তিশালী চক্র রয়েছে।
সক্রিয় ৮০০ দালাল: মালয়েশিয়ায় আদম পাচারের অন্যতম দালাল হচ্ছে থাইল্যান্ডের মানংকি নামের এক মহিলা। তাঁর সহযোগী রয়েছেন সেখানকার সমকেয়াট, সোয়ানচেই, উচেন, চাংকম, পুচিক, আ কন, মালয়েশিয়ায় টেকনাফের আয়ুব খান, মিয়ানমারের মংডুতে নুর মোহাম্মদ, বুচিদং এলাকায় আবদুর রাজ্জাক, আকিয়াবে ছলিম উল্লাহ, সেন্ট মার্টিনে মৌলভী রহিম, টেকনাফের নয়াপাড়ার লালমিয়া প্রকাশ দুয়াইন্না, শাহপরীর দ্বীপে ধলুহোসন, টেকনাফে নায়াপাড়া শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা হাফেজ আয়ুব, আবদুল হাফেজ, মাহমুদুল হাসানসহ অনেকে।
নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, মেহেরপুরেরও এ রকম অনেক দালাল রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় মামলা আছে।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজার, নরসিংদী, যশোরসহ দেশের ১৯ জেলার ৪৬৯ জন দালালের বিরুদ্ধে জেলার বিভিন্ন থানায় পুলিশের ৬০টি মামলা রয়েছে। আরও সাড়ে তিন শ দালালের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ৯০ জনের বেশি দালালকে ধরে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
তৎপর সন্ত্রাসী ও জলদস্যু বাহিনী: কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান জানান, ১২০ কিলোমিটার সাগর উপকূলে মাছ ধরার ট্রলারে লুটপাটের পাশাপাশি ১২টি জলদস্যু বাহিনী দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আদম পাচার চালাচ্ছে। টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে গরমিল হলে সংঘর্ষও বাধে।
পুলিশ জানায়, গত ১৪ আগস্ট ভোরে কক্সবাজারের দরিয়ানগর উপকূলে যাত্রী অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটি সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় মো. শাহজাহান (৩৮) নামের এক দালাল নিহত হন। তিনি সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের বড়ছড়া গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, গত ১১ জুন সকালে সেন্ট মার্টিন সাগরে ৩১৮ মালয়েশিয়াগামী যাত্রীবাহী একটি ট্রলারে বেপরোয়া গুলি চালায় সন্ত্রাসী বাহিনী। এ সময় ট্রলারের পাঁচ যাত্রী নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন আরও ৬৩ জন।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, ‘একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যানারে আমরা উপকূলজুড়ে গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালালেও সমুদ্রপথে মানব পাচার বন্ধ হচ্ছে না। মানব পাচারের মূল হোতাদের শনাক্ত করা গেলেই এ তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব।’
তথ্য সূত্রঃ প্রথম আলো