লোভে পড়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করতে কাতারে যাচ্ছে বাংলাদেশিরা। দুই হাজার ৯৩৫ জন বাংলাদেশি এরই মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করেছে দেশটির হামাদ মেডিক্যাল করপোরেশনের (এইচএমসি) অধীন কাতার অর্গান ডোনেশন সেন্টারে (এইচআইবিএ)। সরকারি মেডেল, আজীবন স্বাস্থ্য বীমা, জীবন বীমাসহ নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার আশায় কিডনি, লিভার, হার্টের ভাল্ভসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানে আগ্রহ দেখিয়ে নাম নিবন্ধন করছে বাংলাদেশিরা, যাদের বেশির ভাগই শ্রমিক শ্রেণির। কাতারের ১২টি শপিং মলে কাজ করে তারা।
কাতারের নাগরিকদের প্রাণ রক্ষার এই কর্মসূচিতে বাংলাদেশের পাশাপাশি আরো অংশ নিচ্ছে ভারত, ফিলিপাইন, নেপাল ও শ্রীলঙ্কানরা। অথচ কাতার বা অন্য আরব দেশের নাগরিকদের এতে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ওই দেশগুলোর মাত্র এক হাজার ৩৪৭ জন এই কর্মসূচিতে নিজেদের জড়িয়েছে। এই কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে নানা সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে।
বিদেশ থেকে ফেরার সময় ‘কাতার ট্রিবিউন’ পত্রিকার একটি শিরোনামে চোখ আটকে যায় বাংলাদেশের একজন অতিরিক্ত সচিবের। গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ওই পত্রিকার দ্বিতীয় প্রধান শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘অঙ্গদানে আরো ২৩,০০০ জনের স্বাক্ষর’। পত্রিকাটি পড়ে আরো বিস্মিত হন তিনি। কারণ ওই ২৩ হাজারের মধ্যে বাংলাদেশি দুই হাজার ৯৩৫ জন। পরে তিনি ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখেছেন, গালফ নিউজসহ অন্যান্য গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
হামাদ মেডিক্যাল করপোরেশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, গত রোজার আগে হিবা কর্তৃপক্ষ নতুন করে ৪০ দিনের প্রচারাভিযান শুরু করে। ওই সময় তাদের প্রশিক্ষিত ৪৫০ জন কর্মীকে কাতারের ১২টি শপিং মলে নামানো হয়। ওই ৪০ দিনে ২৩ হাজার দেশি-বিদেশি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিতে নাম নিবন্ধন করে। এর মধ্যে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি ৯ হাজার ৪৬৫ জন ভারতীয়, দুই হাজার ৮০৩ জন ফিলিপিনো, দুই হাজার ৪৮২ জন নেপালি, দুই হাজার ৩৮৩ জন শ্রীলঙ্কান ও ৬৩২ জন পাকিস্তানি রেজিস্ট্রেশন করেছে। ২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রচারাভিযানে এ নিয়ে সব মিলিয়ে ১০৮টি দেশের ৪৩ হাজার নাগরিক অঙ্গদানে রেজিস্ট্রেশন করল। এ সংখ্যা কাতারের জনসংখ্যার ৫ শতাংশ।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওই অতিরিক্ত সচিব কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে নিকটাত্মীয়র জন্যও অনেকে অঙ্গ দিতে রাজি হয় না। অথচ কাতারে থাকা বাংলাদেশিরা হঠাৎ করে কিভাবে এত বেশি মানবিক হয়ে উঠল, তা বোধগম্য নয়।
দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হামাদ মেডিক্যাল করপোরেশনের প্রচারাভিযান সম্পর্কে আমি জানি। তাতে যে কিছু বাংলাদেশি রেজিস্ট্রেশন করেছে, সেটাও জানি। তবে এ সংখ্যা ঠিক কত, তা যাচাই না করে বলা সম্ভব নয়।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কাতারে যেসব বাংলাদেশি রয়েছে, তাদের বেশির ভাগই শ্রমিক। অল্প কিছু প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী বা অন্য পেশার লোকজন রয়েছে। অঙ্গদানে যারা রেজিস্ট্রেশন করছে, তারা কি শুধুই মানবিক বিবেচনায় উৎসাহিত হচ্ছে, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে তা আমার জানা নেই। আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো বাংলাদেশি কথা বলেনি।’
হামাদ মেডিক্যাল করপোরেশনের ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রচারাভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা গেছে। তাতে বলা হয়েছে, এই কর্মসূচির আওতায় হার্ট, কিডনি, ফুসফুস, লিভার, চোখ, চামড়া, হাড় ও হার্টের ভাল্ব দানে উৎসাহিত করা হচ্ছে। মৃতদের পাশাপাশি জীবিত যে কেউ অঙ্গ দিতে পারবে। জীবিতরা একটি কিডনি বা লিভারের একটি অংশ দিলে তাকে কাতার সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানজনক মেডেল দেওয়া হবে। সঙ্গে থাকবে আজীবন মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্স (স্বাস্থ্য বীমা) ও জীবন বীমা সুবিধা। এ ছাড়া অঙ্গ দেওয়ার কারণে দাতার স্বাস্থ্যগত কোনো ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণও দেওয়া হবে। কিডনি দানের পর ভবিষ্যতে দাতার প্রয়োজন হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হবে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দাতা অগ্রাধিকার পাবে। কাতার এয়ারওয়েজের টিকিটের মূল্যে তারা পাবে বিশেষ ছাড়। এ ছাড়া অঙ্গদানের সময় যাতায়াত, হাসপাতালের খরচ, মোবাইল ফোন বিল, হাসপাতালে থাকাকালীন কর্মমূল্যও পরিশোধ করবে হামাদ মেডিক্যাল করপোরেশন। অঙ্গ দেওয়ার পরও জীবনধারণে দাতার কোনো সমস্যা হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রচারাভিযানে।
মৃত ব্যক্তির অঙ্গ দান করলেও প্রণোদনা রাখা হয়েছে। মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের সম্মান জানিয়ে মেডেল দেওয়া ছাড়াও লাশ বিনা খরচে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া লাশের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদেরও বিনা খরচে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।
মানুষকে অঙ্গদানে উৎসাহী করতে কোরআন শরিফের আয়াত ব্যবহার করা হয়েছে প্রচারাভিযানের বুকলেটে। তাতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ বলেছেন, যে একটি জীবন রক্ষা করল, সে যেন পুরো মানবজাতিকেই রক্ষা করল।’ খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি ইসলাম ধর্মেও যে অঙ্গদানের গুরুত্ব রয়েছে সে প্রসঙ্গে বুকলেটে বলা হয়েছে, ইসলামী আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ পণ্ডিতদের বেশির ভাগই জীবন বাঁচানোর নীতিকে গুরুত্ব দিয়ে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পক্ষে মত দিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, হামাদ মেডিক্যাল করপোরেশনের অঙ্গ প্রতিস্থাপন কর্মসূচির প্রধান ড. রিয়াদ আবদুল সাত্তার ফাদিল গত ২১ জুলাই দোহা সিটি সেন্টারে আয়োজিত এ-সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, একজনের অকালমৃত্যু অন্য আটজনকে নতুন জীবন দিতে পারে। সব বয়সের মানুষই দাতা হতে পারে।’