আজ পবিত্র হজ। মুসলিম্উম্মাহর মহামিলনের দিন। লাব্বাইক, আলাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নিমাতা, লাকাওয়াল মুলক অর্থাৎ আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার।
সারা বিশ্বের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কণ্ঠে উচ্চারিত মুহুর্মুহু এ ধ্বনিতে আজ শুক্রবার মুখরিত হয়ে উঠবে ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দান। পবিত্র মক্কা নগরী থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে হজরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-এর পুনর্মিলনের ঐতিহাসিক স্থান এই আরাফাত। আরাফাত ময়দানের জাবেলে রহমাত হচ্ছে পুনর্মিলনের স্মৃতিস্তম্ভ। যেখানে হাজীরা সমবেত হয়ে চুম্বন এবং মোনাজাত করে থাকেন। শুধু তাই নয়, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যভূমি আরাফাত ময়দানের আকাশ-বাতাস ও প্রতিটি বালুকণায় প্রতিধ্বনিত হয় হাজীদের হৃদয়মথিত লাব্বাইক ধ্বনি। চারদিকে শুধুই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শানে হাজির হওয়া দুই প্রস্থ সাদা কাপড় পরা লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ। পবিত্র হাসিদ শরিফের বর্ণনা মতে, হজের তিনটি ফরজের মধ্যে আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আরাফাতে অবস্থান ছাড়া হজ পরিপূর্ণ হয় না। হাজীরা কেউ তাঁবু টানিয়ে, কেউ কেউ সরকারি হজক্যাম্পে আবার অধিকাংশই খোলা আকাশের নিচে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এক কাতারে মিলিত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাবে। ৯ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে প্রায় আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করবেন। আরাফাত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মুজদালিফায় রাত যাপন ও পাথর সংগ্রহ করবেন হাজীরা। ১০ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে মুজদালিফা থেকে আবার মিনায় ফিরে আসবেন। মিনায় এসে বড় শয়তানকে পাথর মারা, কোরবানি ও মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেঁটে মক্কায় কাবা শরিফ তাওয়াফ করার মধ্য দিয়ে হজের প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। তাওয়াফ শেষে মিনায় ফিরে গিয়ে ১১ ও ১২ জিলহজ অবস্থান ও প্রতিদিন তিনটি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবেন।
বিশ্বের প্রায় ১৭৭টি দেশের ২৭ লাখেরও বেশি হজযাত্রীর ৬০ ভাগই শুক্রবার ভোরের মধ্যে পৌঁছে যান আরাফাত ময়দানে। আবার অনেকেই পৌঁছেছেন আগের দিন ভোররাতেই। কাফনের কাপড়ের অনুরূপ দুই খণ্ড শুভ্র বসনে এহরাম বেঁধে লাখ লাখ মানুষ আত্মসমর্পণ করেন মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে। গোনাহ মার্জনা আর বিশ্ব শান্তির জন্য দোয়ায় তাদের কান্নার ধ্বনি, পাপমোচনের ব্যাকুলতা, একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি, মোনাজাত-সৌহার্দ্য বিনিময়ের এ অভূতপূর্ব দৃশ্য স্মরণ করিয়ে দেয় মানবতার ধর্ম ইসলাম, শান্তির ধর্ম ইসলাম, ইসলাম ধনী-গরিবের ভেদাভেদহীন এক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। বিশ্ব শান্তি প্রত্যাশায় মুসলিম উম্মাহ আরাফাতে আবারও সমবেত হয়ে যে যার যার মতো ইবাদতে মশগুল হবেন। চারদিকে পাহাড়ঘেরা বিশাল আরাফাত ময়দানের মাঝে ৭ লাখেরও বেশি মুসল্লির ধারণক্ষমতার মসজিদুল নামিরাহ ভোররাতের মধ্যেই পূর্ণ হয়ে যাবে। আরাফাত ময়দানের মসজিদুল নামিরাহতে খুতবা পাঠ করবেন পবিত্র মসজিদ, মসজিদুল হারাম-মক্কার ইমাম আবদুল আজিজ আল শাইখ। খুতবায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহকে একান্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হবে। মোনাজাতে বিশ্ব শান্তি, ভ্রাতৃত্ব, মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও ঐক্য এবং সারা দুনিয়ার মানুষের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করে জ্ঞাত ও অজ্ঞাত গোনাহর জন্য মহান আল্লাহর দরবারে সবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হবে। পবিত্র হজের মূল পর্ব আরাফাত ময়দানে সবাই মিলিত হয়ে একই আজানে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে আদায় করবেন।
হজযাত্রীদের দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত মোয়াল্লিমের নেতৃত্বে আরাফাত ময়দানে জোহর ও আসর নামাজ একত্রে আদায় শেষে সূর্যাস্তের পর রওনা দেবেন মুজদালিফার উদ্দেশে। চারদিকে উঁচু পাহাড়ঘেরা সমতল উপত্যকা মুজদালিফায় তারা মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করবেন। সৌদি সরকারের বিশেষ ব্যবস্থায় এবারও উন্মুক্ত ময়দানের সব তাঁবু কেবলামুখী করে বাঁধা হয়েছে। আরাফাত ময়দানে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, হেলিকপ্টারসহ ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সার্বক্ষণিক টহল দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এবারও মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় ছোট ছোট অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালে সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গরমের প্রকোপ বেশি থাকায় বিশাল ময়দানজুড়ে শত শত শীতল পানির ফোয়ারার মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে তাপমাত্রা ঠাণ্ডা রাখা হচ্ছে।
মোয়াল্লেম দফতর সূত্র জানায়, জামারাতের কাছে মোয়াল্লেম নম্বর ২২-এর অধীনে থাকবেন বাংলাদেশ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আসা হাজীরা। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এজেন্সির মাধ্যমে আসা হাজীরা থাকবেন ৪, ১৪, ১৮, ২২, ৫৩, ৫৮, ৬৬, ৭১, ৭২, ৭৭, ৮০, ৮১, ৮৪ এবং ৮৭ থেকে ৯০, ৯৩, ৯৪, ৯৫, ৯৮ থেকে ১১৫ মোয়াল্লেম নম্বরের অধীনে। মিনায় হাজীদের সহায়তার জন্য ৬/৫৬ নম্বর তাঁবুতে পাঁচ দিন বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের কার্যক্রম চালানো হবে।