এলিজার সঙ্গে আমার পরিচয় না হলে জীবনের একটি অধ্যায়ের কিছু অংশ হয়তো অপূর্ণই থেকে যেত। এলিজা তার স্বামীকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছে বেশ কয়েকদিন হলো। কলাতলীর সাধারণ মানের একটি হোটেলে থেকে তারা গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে পুরো কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন এবং বান্দরবান চষে বেড়াচ্ছে আর মনের আনন্দে বাংলাদেশের খাবার এবং রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করছে। এরই মধ্যে একদিন বিকালে এলিজার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল হোটেল কক্স টুডের লবিতে। আমি দাঁড়িয়ে ২/৩ জন পরিচিতজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এমন সময় এলিজা এগিয়ে এলেন এবং সালাম দিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। দেশের বাইরে গিয়ে অনেক ভদ্র মহিলার সঙ্গে করমর্দন কিংবা অতিরিক্ত সৌজন্যতা দেখানোর জন্য আলতো করে আলিঙ্গন অথবা গালের সঙ্গে গাল মেলানো একটি সচরাচর ঘটনা। বাংলাদেশে এটি সচরাচর করা হয় না- বিশেষ করে বাংলাদেশি মেয়েদের সঙ্গে তো নয়ই। আমি ইতস্তত করছিলাম দুটি কারণে- প্রথমত, মেয়েটি বাংলাদেশি না বিদেশি বোঝা যাচ্ছিল না। দ্বিতীয়ত, পাবলিক প্লেসে একজন অপরিচিত সুন্দরী যুবতীর সঙ্গে করমর্দন করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না।
এলিজার পরনে ছিল টাইট জিন্স এবং গায়ে দামি টি-শার্ট। হাতের ওমেগা ঘড়িটির চাকচিক্য দেখে বোঝাই যাচ্ছিল তিনি বেশ ধনাঢ্য। লম্বায় আমার কাছাকাছি অর্থাৎ ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, গায়ের রং আরব দেশের মেয়েদের মতো গোলাপি আর মায়াবী মুখখানা বাংলাদেশি আদলে গড়া। তিনি বোধ হয় আমার সমস্যা আন্দাজ করতে পারলেন। তাই পরিশুদ্ধ ব্রিটিশ ধাঁচের ইংরেজি উচ্চারণে বললেন- জনাব, আপনার সঙ্গে একটু পরিচিত হয়ে ২/১টা বিষয় শেয়ার করতে চাই। আমার নাম এলিজা, লন্ডন থেকে এসেছি। দাদার বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। আমার বাবার জন্ম ইংল্যান্ডে। আর আমারও তদ্রূপ। বড় হওয়ার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রবল আগ্রহ অনুভব করি, তাই বিয়ের পর হানিমুন করতে বাংলাদেশে চলে এলাম। এলিজার কথায় আমার সব জড়তা দূর হয়ে গেল এবং আমি তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটির সঙ্গে করমর্দন করে জিজ্ঞাসা করলাম- আমার সঙ্গে কি এমন কথা, কারণ আমাকে তো আপনার চেনার কথা নয়। এলিজা মিষ্টি করে হাসল এবং অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্বামী জনকে ইশারায় আমাদের কাছে আসতে বলল এবং সব শেষে আমার সম্পর্কে অদ্ভুত এবং মজাদার একটি কথা বলল। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে বলে নেই কেন আমি কক্সবাজারে গেলাম বা কক্স টুডে হোটেলে উঠলাম।
আমার চট্টগ্রামের বন্ধু কাইউম চৌধুরী বেশ কয়েক বছর আগে তার কয়েকজন আত্দীয়স্বজন নিয়ে কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল জোনে বিরাট এক পাঁচতারা মানের হোটেল নির্মাণ করেছে দি কক্স টুডে নাম দিয়ে। বন্ধুবরের নিমন্ত্রণ ছিল সস্ত্রীক তার হোটেলে কয়েক রাত বেড়িয়ে আসার জন্য। আমি ইন্টারনেটে হোটেলটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেখে ভারি আশ্চর্য হলাম। বাংলাদেশের কক্সবাজারে এত বড়, এত ভালো মানের আধুনিক হোটেল তৈরি হয়েছে তা আমার বিশ্বাসই হতে চাচ্ছিল না। প্রায় ৪০০ কামরাসংবলিত দশতলার হোটেলটিতে ঢাকার সোনারগাঁও, র্যাডিসন কিংবা ওয়েস্ট ইন হোটেলের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। অধিকন্তু হোটেলটির রুমগুলোর ফিটিংস এবং আয়তন ঢাকার হোটেলগুলোর চেয়ে বড়। বিশেষ করে প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট এবং ডিলাক্স স্যুটের জাঁকজমকের কথা শুনে খুবই ইচ্ছা জাগল কক্সবাজারে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য। প্রায় বছরখানেক ধরে চেষ্টা করছি কিন্তু পরিবারের শিডিউল মেলাতে পারছিলাম না। তাই হুট করে টিকিট কেটে একাই চলে এলাম নীরবে-নিভৃতে দুদণ্ড কাটিয়ে যাওয়ার জন্য।
আমার বন্ধুকে আগেই বলা ছিল আমার আগমনী সংবাদ গোপন রাখার জন্য। সে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। এয়ারপোর্ট থেকে কালো গ্লাসের ভিআইপি গাড়িতে করে মহা সতর্কতার সঙ্গে রুমে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সম্ভবত ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই অনুসরণ শুরু করেছিল। কক্সবাজার এয়ারপোর্ট নামার পর বুঝলাম, অনেকগুলো চোখ অনুসরণ করছে। সম্ভবত তারাই স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালীর কাছে আমার আগমনের কথা ফাঁস করে দেয়। ফলে কতিপয় লোক হোটেলে আসেন সাক্ষাৎ করার জন্য। আর এমনি এক সাক্ষাৎপর্বে এলিজার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে যায়।
এলিজার স্বামী একজন ব্রিটিশ। সে এসে করমর্দন করল। আমরা বিস্তারিত কথা বলার জন্য বিশাল লবিতে মেহমানদের জন্য যেসব চেয়ার, টেবিল ও সোফা রয়েছে তার একটিতে গিয়ে বসলাম। আমার সঙ্গে আলাপরত লোকজনও কৌতূহলবশত আমাদের সঙ্গে গিয়ে বসল। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, বিশ্বের নামকরা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এলিজা এবং তার স্বামী সরকার ও রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। আমি কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলাম- এবার বলুন তো কেন আপনি আমার সঙ্গে উপযাচক হয়ে পরিচিত হলেন যা সাধারণত ব্রিটিশরা করে না। এলিজা বললেন, আমরা গত ১৫ দিন ধরে কঙ্বাজারের প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরছি। নানাজনের সঙ্গে কথা বলছি। সাধারণ মানুষ দেশের বর্তমান রাজনীতি নিয়ে খুবই হতাশ। তারা কোনো রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধিকে বিশ্বাস করে না। নিজের বা সমাজের কোনো বিষয় নিয়ে জনপ্রতিনিধির ওপর নির্ভর করা যায় এমন মনমানসিকতা সাধারণ মানুষের মধ্যে আমরা দেখিনি। তারা ক্ষমতাবান লোকদের চরিত্রহীন, লম্পট, দুর্নীতিবাজ এবং জনগণের অর্থ লোপাটকারী হিসেবেই ভাবে। তারা এ কথাও ভাবে, বাংলাদেশে কোনো লোক ব্যক্তিগত স্বার্থ, উচ্চাভিলাষ এবং পদ-পদবির লোভ ছাড়া কেবল জনকল্যাণের মনমানসিকতা নিয়ে রাজনীতিতে আসে না।
আমি নির্বাক হয়ে এলিজার কথা শুনছিলাম। অপমানে আমার শরীর দিয়ে মৃদু ঘাম বের হচ্ছিল। হোটেল লবিটি ছিল বিশাল, আর সেখানকার চাকচিক্য, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ সব কিছুই ছিল মনোরম। কিন্তু এলিজার কথা শোনার পর সব কিছু কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমরা যেখানে বসেছিলাম তার পেছনে পিতলের তৈরি বিশাল এক ষাঁড়ের মূর্তি ছিল। এত সুন্দর এবং দামি মূর্তি আমি অন্য কোথাও দেখিনি। গত কয়েক দিনে আমি লবিতে ঘোরার সময় বার বার মূর্তিটির দিকে তাকাতাম এবং ভাবতাম ওটা যত সুন্দর তার তুলনায় এক কোটি টাকা মূল্য কোনো ব্যাপারই নয়। কিন্তু সেদিন ষাঁড়টিকে আমার ভীষণ ভয়ঙ্কর মনে হতে লাগল। মনে হলো এই বুঝি পিতলের মূর্তি প্রাণ ফিরে পেল এবং রাজনীতিবিদ মনে করে আমাকে গুঁতা মারতে এলো। আমি কি জবাব দেব তা ভেবে পেলাম না বা এ কথাও মনে এলো না যে, এলিজা তো আমাকে চেনার কথা নয়, ও হয়তো এমনি এমনি বলছে! চোরের মনে যেমন পুলিশ পুলিশ ভয় থাকে তেমনি এলিজার মুখে রাজনীতিবিদদের বদনাম শুনে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ের চোটে আমি তার দিকে ভালোভাবে তাকাতে পারছিলাম না। তার মতো অসাধারণ কোনো সুন্দরী যুবতীর সামনে বসে যেকোনো পুরুষই বিমোহিত হবে। তার সারা শরীরের দিকে চুপিসারে চোখ বুলাবে। কিংবা সে যখন এক পায়ের ওপর থেকে অপর পা’টি সরিয়ে ক্ষণিকের জন্য দু’পা ঈষৎ ফাঁক করে দোলাতে থাকবে তখন পুরুষের চোখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু একটার দিকে নজর করবে। তা ছাড়া টি-শার্টের রং বা ব্রান্ডের নাম জিজ্ঞাসার ছলে আরও কিছু অংশের দিকে নজর বুলাবে। আমার সঙ্গী লোকগুলো এলিজার কথা শুনে খুব মজা পাচ্ছিল এবং মাথা নেড়ে তাকে এমনভাবে সমর্থন জোগাচ্ছিল যাতে সে আরও কিছু টাটকা কথা আমাকে শুনিয়ে দেয়।
এলিজা আরও বলল, এ দেশে এমপিরা খুন করে, মাদক চোরাকারবারীর সঙ্গে জড়িত থাকে। রাত-বিরাতে রংমহলে যায়, জোর করে ২ নম্বর বা ৩ নম্বর বউ হিসেবে কারও কন্যা বা স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে আসে। অবৈধ উপার্জনের টাকা দিয়ে নেশা করে এবং জুয়া খেলে, দেশ ও জাতির সর্বনাশ ঘটায়। সমাজের কুৎসিত চেহারার এবং কুৎসিত আকৃতির লোকেরা নেতা হয় অথচ দুনিয়ার সব জায়গার রাজনৈতিক নেতৃত্বের চেহারা, সুরত, আকার-আকৃতি শিক্ষা-দীক্ষা, বংশ মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা দেশের সাধারণ মানুষের গড়পড়তা অবস্থানের চেয়ে উঁচুমানের হয়। জন্মগত, পরিবেশগত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই নেতারা সাধারণ মানুষের চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ হন। ফলে জনগণের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আস্থা লাভ করতে তাদের কোনো কষ্টই হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে দেখলাম উল্টো। ইউনিয়ন পরিষদের একজন মেম্বর থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত একজন লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ যার আশপাশের লোকজন, সহকর্মী, সুবিধাভোগী এবং অধীনস্ত অধস্তনরা গর্ব করে বলবে- ‘আমাদের নেতা সব দিক থেকেই আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর।’
আমি আর পারছিলাম না, ধৈর্যহারা হয়ে পড়ছিলাম। আমার ভয় হচ্ছিল আমি হয়তো এলিজার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে ব্রিটিশদের বহু নোংরা ইতিহাস তাকে স্মরণ করিয়ে দেব। অথবা তাকে স্মরণ করিয়ে দেব একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে এত্তসব বিষোদগার করা কি ঠিক। আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। হোটেল কর্তৃপক্ষ ঢাকার পাঁচতারা হোটেলগুলোর মতো লবিতেই হালকা পানীয় এবং স্ন্যাকসের ব্যবস্থা রেখেছে। আমি ওয়েটারকে ডেকে যখন কফির অর্ডার দেব দেব ভাবছিলাম ঠিক তখনই এলিজা চিরায়ত মোহনীয় এবং কমনীয় রমণীর বেশ ধারণ করলেন। তিনি হেসে বললেন জনাব রনি! আপনি নিশ্চয়ই আমার প্রতি বিরক্ত হচ্ছেন। আপনার মুখ দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পারছি আপনি আমায় ঘৃণা করতে শুরু করেছেন এবং এ স্থান থেকে সরে পড়তে চাচ্ছেন। আমি ঢোক গিললাম এবং বিরস বদনে জবাব দিলাম, না ঠিক তা নয়। এলিজা বললেন, চলুন আমরা সুইমিংপুলের পাশে বসে কফি পান করি। পড়ন্ত বিকালের নির্মল দখিনা বাতাসে আমার সঙ্গে কফি খেতে নিশ্চয়ই আপনার মন্দ লাগবে না। কারণ, এরপর আমি যা বলব তাতে আপনার খারাপ লাগার কোনো সম্ভাবনা নেই, বরং মনে হচ্ছে ভালোই লাগবে, এ কথা বলে সুন্দরী এলিজা অর্থপূর্ণ বাঁকা হাসি দিল। এই প্রথম আমি ভালো করে তার মুখের দিকে তাকালাম এবং লক্ষ্য করলাম হাসলে এলিজার গালে অসম্ভব সুন্দর টোল পড়ে।
এলিজাই প্রথম উঠে দাঁড়ালেন এবং আমার হাত ধরে টান দিয়ে উঠালেন। এক হাতে স্বামী আর অন্য হাতে আমি! তিনজন হাত ধরে সুইমিংপুলের পাশে গিয়ে বসলাম। আমার সঙ্গী-সাথী এবং হোটেলের লোকজন এ আজব দৃশ্য দেখে ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল। বেশ প্রশস্ত এবং বড়সড় সুইমিংপুল। প্রতি সন্ধ্যায় পুল পাড়ে জাঁকজমকপূর্ণ বার বি কিউ পার্টি হয়, সঙ্গে গান বাজনা। পড়ন্ত বিকালে সুইমিংপুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টাফরা সন্ধ্যার পার্টির আয়োজনের জন্য ব্যস্ত ছিল। এ সময় সাধারণত কোনো অতিথিকে পুলপাড়ে আলাদা করে আপ্যায়ন তাদের জন্য একটু কষ্টকর। কিন্তু সম্ভবত এলিজার জন্যই ওয়েটাররা হাসিমুখে আমাদের বসতে দিলেন এবং চাহিদা মতো কফি সরবরাহ করলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, প্রিয় এলিজা! এবার দয়া করে ঝটপট বলে ফেলুন তো কেন আপনি আমার সঙ্গে যেচে পরিচিত হতে গেলেন!
আমার কথা শুনে এলিজা এবার বেশ কৌতুক অনুভব করলেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন, একটি প্রয়োজনে হোটেলটিতে এসেছি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে লবিতে দাঁড়িয়েছিলাম। লক্ষ্য করলাম সবাই আপনার প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দিচ্ছে। অনেকে ছবি তুলছে। হোটেলের মেহমানরা আপনার সামনে দিয়ে যাতায়াতের সময় বিনয় সহকারে সালাম বিনিময় করছে এগিয়ে গিয়ে করমর্দন করছে। বিশেষ করে দম্পতিরা যেমন নিজেরা আপনার সঙ্গে ছবি তুলছেন তেমনি তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও ছবি তুলে রাখছেন। আমি ধারণা করলাম, আপনি হয়তো দেশের নামকরা কোনো সম্মানিত সেলিব্রেটি। হোটেলের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা উনি কে? সে উত্তর করল, গোলাম মাওলা রনি! আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তা উনি কি করেন আর লোকজন কেনইবা তাকে এত পাত্তা দিচ্ছে। হোটেলের কর্মকর্তাটি বলল, উনি সরকারদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য, কলাম লেখক এবং টেলিভিশনের অতি পরিচিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি সরকারের কিছু অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে খোলামেলা বক্তব্য দিয়ে বেশ আলোচিত এবং সম্প্রতি সরকারের ঘনিষ্ঠ এক ঘৃণিত ব্যক্তির চক্রান্তে জেল খেটে আসার পর সাধারণ মানুষ তার প্রতি বেশ সহানুভূতিপ্রবণ হয়ে পড়েছে।
হোটেলের কর্মকর্তার কাছে আপনার বিষয়ে শোনার পর আমার ইচ্ছা হলো পরিচিত হওয়ার জন্য। তারপর মনে হলো, দেখি ভদ্র লোকের ধৈর্যশক্তি কেমন! তাই গত কয়েকদিনে এ দেশের রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে শোনা বাজে মন্তব্যগুলো বলে আপনাকে রাগানোর চেষ্টা করলাম। ধরতে পারেন, এটা সুন্দরী নারীদের এক ধরনের রহস্যময় ছলচাতুরি! এ কথা বলেই এলিজা হো হো করে হাসতে লাগলেন। হাসি থামিয়ে এলিজা বললেন, জনাব রনি, আমি খুবই দুঃখিত। আমার মনে হচ্ছে, আপনার ধৈর্যশক্তির পরীক্ষা নিতে গিয়ে আমি বোধ হয় সীমা অতিক্রম করেছি। আমায় ক্ষমা করুন আর যদি আপনার দয়া হয় তবে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিবাচক কিছু বিষয় আমাকে বলুন।
এলিজার কথায় আমার মন ভালো হয়ে গেল। আমি সংক্ষেপে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের ভালো ভালো দিকগুলো তথ্য-প্রমাণ সহকারে তাকে বললাম। গত একদশকে রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সফলতার দিকগুলো তুলে ধরলাম। এ ছাড়া এ দেশের মেহনতি সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, আমলা ও সামরিক কর্মকর্তাদের ভালো ভালো দিকগুলো একে একে উপস্থাপন করে এলিজাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম, এ দেশ খুব তাড়াতাড়ি বিশ্ব রাজনীতির মনোযোগের কেন্দ্র হবে এবং একটি ধনী রাষ্ট্র ও সভ্য জাতি হিসেবে আত্দপ্রকাশ করবে। আলোচনার শেষ পর্যায়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা আপনি এ হোটেলে এসেছেন কেন? কারণ আপনি তো এখানে থাকছেন না!
আমার কথা শুনে এলিজা হঠাৎ মুখ ভার করে ফেললেন। বিরস বদনে বললেন, আমরা যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি তার সদর দফতর ব্রাসেলসে। কক্সবাজারের কিছু ছবি আমার বসকে পাঠানোর পর তিনি সস্ত্রীক এখানে বেড়াতে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমাদের প্রতিষ্ঠানটি পুরো ইউরোপে খুবই নামকরা এবং বসও যথেষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি। ব্যক্তিগত বিমানে সব জায়গায় চলাফেরা করেন। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিমান নিয়ে আসা নানারকম ঝক্কি-ঝামেলার বিষয়। আর বসের বিমানটি কক্সবাজার বিমান বন্দরে ল্যান্ড করানো সম্ভব হবে না, কারণ এটির রানওয়ে আন্তর্জাতিক মানের নয়। বসকে এসব জানানোর পর তিনি কমার্শিয়াল প্লেনে আসতে রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত দিলেন খুব ভালো মানের হোটেল এবং সেই হোটেলের একটি উপযুক্ত স্যুটরুম। রুমের সঙ্গে থাকতে হবে কমপক্ষে দুটি বেডরুম, লিভিংরুম, ২/৩টি বাথরুম। বাথরুমের সঙ্গে ব্যক্তিগত জ্যাকুজি, সাউনা, স্টিম ইত্যাদি। আরও থাকতে হবে রান্নাঘর, বার, ফয়ার, ফ্যামিলি স্পেস এবং খোলা প্রশস্ত বেলকনি যেখানে বসে সমুদ্র এবং আকাশের চাঁদ একসঙ্গে দেখা যায়। বসের চাহিদা শুনে আমার তো চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা। আমি কক্সবাজারের শীর্ষ তিনটি হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটের ছবি তুলে বসকে পাঠালাম। বস সেগুলো দেখার পর কক্স টুডের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটটি বুক করতে বললেন।
কিন্তু আজ বুকিং দিতে এসে নতুন সমস্যায় পড়লাম। দেখলাম এ হোটেলটির বার পরিচালনার লাইসেন্স নেই। অথচ অন্য দুটি হোটেলের রুম আমাদের বসের পছন্দ না হলেও সেখানে অনুমোদিত বার রয়েছে। এ অবস্থায় বস হয়তো এই হোটেলে বুক দিতে নাও করতে পারেন। অন্যদিকে অন্য হোটেলে বার থাকা সত্ত্বেও তাদের রুম কোয়ালিটি কাঙ্ক্ষিত না হওয়ায় বস হয়তো বাংলাদেশেই আসতে চাইবেন না। এলিজার কথা শুনে আমি বললাম, তুমি নিশ্চিন্তে বুকিং দিতে পার। কারণ যেকোনো বিদেশি নাগরিক বিদেশ থেকে আসার সময় তার পছন্দ মতো পানীয় যেমন নিয়ে আসতে পারেন তেমনি স্থানীয় বার বা ওয়্যার হাউস থেকে পাসপোর্ট দেখিয়ে কিনে নিতে পারেন। আর হোটেল রুমে বসে যেকোনো বিদেশি নাগরিকের মদ্যপানে কোনো আইনগত বাধা-নিষেধ নেই। আমার কথা শুনে এলিজা খুশি হয়ে গেলেন এবং বার বার ধন্যবাদ জানাতে লাগলেন।
লেখক : রাজনীতিক। উৎসঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন