কোনো একটি সরকারের বিশাল কর্মযজ্ঞ যাত্রা শুরু করে ওই সরকারের মন্ত্রীদের হাত ধরে। সঙ্গত কারণেই তারা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তবে নানা সময়ে সরকারের বেশ কজন মন্ত্রী এমন অনেক কর্মকাণ্ড করেছেন বা বক্তব্য দিয়েছেন যার ফলে ম্লান হয়েছে সরকারের অর্জন ও ভাবমূর্তি।
৫ জানুয়ারির ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের দিনকয়েক পর থেকেই এসব বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্ক শুরু হয় ২১ জানুয়ারি ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান নিয়ে। কনকনে শীতের মধ্যে পাবনা-ঈশ্বরদী মহাসড়কে ঈশ্বরদী উপজেলার রামচন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের শিক্ষার্থীদের। মন্ত্রীর ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের অনেকেই জানতো না কেন তারা এই শীতের সকালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
এই রেশ কাটতে না কাটতেই ২৪ জানুয়ারি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া শাহরিয়ার আলমের একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। এবার স্থান রাজশাহীর বাঘা উপজেলা। প্রতিমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে ওইদিন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের প্রায় দুঘণ্টা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। অভিযোগ পাওয়া যায়, অনেক শিক্ষার্থী ক্ষুধায় কাহিল হয়ে পড়লেও সেই দুপুরে তাদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ওই অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রীকে একটি সোনার নৌকা ও সোনার কোটপিন উপহার হিসেবে দেয়া হয়। বিতর্কটা আসলে তার এই উপহার পাওয়া নিয়ে নয়। বিতর্কের বিষয়টা ছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা নিয়ে। অবশ্য সোনার নৌকা ও সোনার কোটপিন উপহার পাওয়ার পর শাহরিয়ার আলম ভবিষ্যতে তাকে এ ধরনের উপহার না দিতে সবার প্রতি অনুরোধ করেন। এর পরদিনই ওই সোনার নৌকা বিক্রির টাকা তিনি দান করে দেন প্রত্যাশা নামের স্থানীয় একটি প্রতিবন্ধী শিশু সংস্থায়।
এরপরের ঘটনাটি আগের সবকটি ঘটনাকে হার মানিয়ে দেয়। কারণ আগের ঘটনাগুলো কোনো না কোনোভাবে বিতর্ক তৈরি করলেও এগুলোতে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী সরাসরি জড়িত ছিলেন না। কিন্তু ২৭ জানুয়ারি স্কুলপড়ুয়া শিশুদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে গিয়ে মঞ্চে বসেই প্রকাশ্যে ধূমপান করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী। তার এই ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে অবশ্য এ ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন মন্ত্রী।
এরপর ১৫ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক অনুষ্ঠানে জুতা পায়ে দিয়েই শহীদ মিনারে উঠে পড়েন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রতিমন্ত্রী একা নন ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্যান্য অতিথিরাও সেদিন জুতা পায়ে দিয়েই শহীদ মিনারে উঠে পড়েন। পরে অবশ্য তারা বলেন, এটি যে শহীদ মিনার, তা আমাদের জানা ছিল না।
ওই অনুষ্ঠানে শহীদ মিনারের তিনটি স্তম্ভকে চাদর দিয়ে আড়াল করে বেদিতে অতিথিদের বসার মঞ্চ করা হয়। সামনে ছিল দর্শকদের বসার স্থান।
পরবর্তীতে ৯ আগস্ট ফের আলোচনায় আসেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী। এবার তিনি ইচ্ছেমতো সাংবাদিকদের কথা শোনান। খবিশ বলেও গালি দেন মন্ত্রী। সাংবাদিকদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, ‘তোমাদের কোমর কীভাবে ভাঙতে হয় আমি তা জানি। তোমরা চরিত্রহীন, লম্পট, বদমাইশ। তোমরা টাকা খাও অন্যের, আর মহসিন আলীর বিরুদ্ধে লিখ। এটা আর হবে না, খুব সতর্ক থাকবে। ধরলে কিন্তু ছাড়া হবে না।’
আর সর্বশেষ রোববার বিকেলে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের একটি হোটেলে নিউইয়র্কে বসবাসরত টাঙ্গাইলবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় কালে মহানবী (সা.), হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী।
ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আব্দুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ চিন্তা করলো এ জাজিরাতুল আরবের লোকেরা কীভাবে চলবে? তারাতো ছিল ডাকাত। তখন সে একটা ব্যবস্থা করলো যে আমার অনুসারীরা প্রতিবছর একবার একসঙ্গে মিলিত হবে। এর মধ্য দিয়ে একটা আয়-ইনকামের ব্যবস্থা হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী, জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী, তবে তার চেয়েও বেশি হজ ও তাবলিগ জামাতের।’
হজ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এ প্রবীণ নেতা বলেন, ‘হজের জন্য ২০ লাখ লোক সৌদি আরবে গিয়েছে। এদের কোনো কাম নাই। এদের কোনো প্রডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে।’
তাবলিগ জামাতের সমালোচনা করে মন্ত্রী বলেন, ‘তাবলিগ জামায়াত প্রতিবছর ২০ লাখ লোকের জমায়েত করে। নিজেদেরতো কোনো কাজ নেই। সারা দেশের গাড়িঘোড়া তারা বন্ধ করে দেয়।’
এ ঘটনার জেরে লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বেফাঁস কথা বা অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড যে শুধু আওয়ামী সরকারের মন্ত্রীরাই করেছেন এমন নয়। বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলেও ওই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ‘আল্লার মাল আল্লাহ নিছে’ বলে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন।