কোরিয়ান ইপিজেড বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কের সেতুবন্ধন হতে পারত। কোরিয়ান ইপিজেড দিয়েই কোরিয়া হতে পারত বাংলাদেশের এক নম্বর বিনিয়োগকারী দেশ। দেড় যুগ ধরে শুধু সম্ভাবনার কথা শুনে যেতে হচ্ছে। নানা সমস্যা আর হতাশার মধ্য দিয়ে চলতে থাকা কোরিয়ান ইপিজেডকে নিয়ে লিখেছেন মো. মহিবুল্লাহ।
ফিরে দেখা…
সময়টা ১৯৯৪-৯৫ সাল। বাংলাদেশ-কোরিয়ার দুই দশকের সম্পর্ক উভয় দেশের সরকার প্রধানদের দ্বিপাক্ষীয় সফরে নতুন দিগন্ত দেখছে। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ঢাকা-সিউল যৌথ উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রস্তাব উঠলো কোরিয়ান মালিকানায় একটি বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে এলো এ দেশের পোশাক শিল্পে অগ্রযাত্রার দীর্ঘদিনের সহযাত্রী ইয়ংওয়ান কর্পোরেশন।
বিষয়টিকে আইনগত বৈধতা দিতে এক বছরের মধ্যেই পাস হয় বাংলাদেশ বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল অধ্যাদেশ ১৯৯৬। ইয়ংওয়ানের হাত ধরে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় দেশের প্রথম বেসরকারি ইপিজেড, কোরিয়ান ইপিজেডের (কেইপিজেড)। ওই বছরের ১১ই নভেম্বরের মধ্যে কর্তৃপক্ষকে জমি বুঝিয়ে দিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়।
কি ছিল পরিকল্পনায়?
পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ আড়াই হাজার একর জমি বরাদ্ধের আবেদন জানায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী এর প্রায় অর্ধেকটায় কলকারখানা স্থাপন করা হবে। বাকি অংশে উন্নত বিশ্বের ইপিজেডগুলোর ন্যায় প্রাকৃতিক পরিবেশবান্ধব সবুজ অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ১০০ একর জমিতে আইটি পার্ক স্থাপন যেখানে প্রায় ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এতে ১০ হাজার লোকের আবাসিক সুবিধা থাকবে। এছাড়া ৪টি ২৫তলা বিশিষ্ট বিজনেস সেন্টার, নার্সিং ইনস্টিটিউটসহ ৮০০ বেডের বিশেষায়িত হাসপাতাল, আবাসিক সুবিধাসহ ৩ হাজার কারিগরি ছাত্র-ছাত্রীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, ১২শ ছাত্র-ছাত্রীর জন্য কলেজ এবং কমিউনিটি কমপ্লেক্স তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। জোনে কর্মরত বিদেশিদের জন্য ১৮ হোলের গলফ কোর্স তৈরি করা হবে, থাকবে স্টেডিয়ামসহ অন্যান্য বিনোদন ব্যবস্থা।
অতঃপর শুরু আঠারো মাসের বছর…
জমি বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশনা প্রদান পর্যন্ত ভালোই চলছিল। কিন্তু অজানা রহস্যজনক কারনে এরপর থেকেই সুরটা কোথাও কেটে যেতে শুরু করে। নানা টালবাহানায় জমি আর বরাদ্ধ হয় না। তিন বছর কালক্ষেপণের পর ১৯৯৯ সালের আগস্টে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষকে হুকুম দখলের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্ব তীর লাগোয়া আনোয়ারা ও কর্নফুলী থানা এলাকায় ২ হাজার ৪৯২ দশমিক ৩৫৭৩ একর জমির দখল বুঝিয়ে দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
সরকার ভূমি চিহ্নিত করে মূল্য নির্ধারণ করে দেবার পর ইয়ংওয়ান কর্তৃপক্ষ পুরো অর্থ পরিশোধ করে। শুরু হয় ভূমির উন্নয়ন। সে বছরই ৩০ অক্টোবর কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (কেইপিজেড) অধিগ্রহণকৃত এলাকাকে ‘অর্থনৈতিক জোন’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গেজেট জারি করা হয়। গেজেট প্রকাশের দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
দীর্ঘসূত্রিতার দেড় যুগ!
জমি পেয়ে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ পুরোদমে কাজে লেগে গেলেও জমির বৈধ অনুমতি প্রদান নিয়ে শুরু হয় নতুন জটিলতা। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণের অন্যতম প্রধান পূর্ব শর্ত অপারেশনাল লাইসেন্স, পরিবেশগত ছাড়পত্র ও নামজারির (মিউটেশান) জন্য মালিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বছরের পর বছর এখানে ওখানে ধরনা দিয়ে বেড়ান। জমি বরাদ্ধের ৮ বছর বাদে ২০০৭ সালে মেলে অপারেশনাল লাইসেন্স।
নামজারির বিষয়টি তখনও আশ্বাসেই ঝুলিয়ে রাখা হয়। এমন অনিশ্চয়তার মাঝেও কর্তৃপক্ষ গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানি সংযোগের জন্য আবেদন করে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশাসন যেন ডেকে এনে হয়রানির ষোলকলা পূর্ণ করার পণ করে বসেছে! বিদ্যুতের জন্য ইয়ংওয়ানকে বিনিয়োগ করতে বলা হয়। ২৫ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করে পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ লাইনসহ সাব-স্টেশন। ৮৪ লক্ষ টাকা জামানত রাখা হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কোষাগারে। গত বছর ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য কেইপিজেডের পাশে একটি ১৩২/৩৩ কেভি সাব-স্টেশন নির্মাণ করে সরকার। অবশেষে ২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে কেইপিজেডে।
তবে সে আলোয় হয়রানির অন্ধকার কাটে নি। মাত্র ১৩ দিন বাদেই ‘অবৈধ’ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় স্থানীয় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। এবার অনেকটা বাধ্য হয়েই আদালতের শরণাপন্ন হয় মালিকপক্ষ। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশেও ফিরিয়ে দেয়া হয় নি বিদ্যুৎ সংযোগ। আজতক মেলে নি গ্যাস আর পানির দেখাও।
২০০৩ সালে আবেদন করার ছয় বছর পর ২০০৯ সালে প্রদান করা হয় পরিবেশগত ছাড়পত্র। বহু পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেয়া এই ছাড়পত্র দু’ দফায় বাতিল করে পরিবেশ অধিদপ্তর। পাহাড় কাটার অভিযোগে মামলাও হয় ইপিজেড কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে ছাড়পত্র ফিরিয়ে দেয়া হলেও মামলা প্রত্যাহার হয় নি এখনও।
মূল্য পরিশোধের চৌদ্দ বছরেও জমির নামজারি না করে এখন সুর বদলাচ্ছে প্রশাসন। বলা হচ্ছে ৫০০ একরের বেশী জমির নামজারি সম্ভব নয়! অথচ সাড়ে আটশ একরের মতো জমি বিনিয়োগ কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত করে বসে আছে কর্তৃপক্ষ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে ব্যবসা নয়, ইপিজেড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে আজন্ম পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে ইয়ংওয়ান!
যা কিছু অগ্রগতি…
ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকায় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কাজের পরিবেশ সম্বলিত ১ লক্ষ বর্গমিটার ফ্লোর এরিয়ার ১০টি কারখানা ইউনিটের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। শতভাগ রপ্তানিমুখী এসব ইউনিটে মার্কিন পুমা ব্রান্ডের জুতা উৎপাদিত হচ্ছে যা কোরিয়া, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ইপিজেডে আরও আটটি কারখানা নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সেখানে বর্তমানে প্রায় ৯ হাজার স্থানীয় লোক কাজ করছেন।
এছাড়া প্রস্তাবিত সবুজ অঞ্চলে দেড় লক্ষাধিক প্রজাতির গাছ এবং ঘাস লাগানো হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় ১৩০ মিলিয়ন গ্যালন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা মৃতপ্রায় অঞ্চলটির গাছপালা ও প্রাণীকুলে নতুন জীবন সঞ্চার করেছে।
রয়েছে স্থানীয়দের বাধা
কেবল প্রশাসনিক জটিলতা আর আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতায়ই নয়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাধার কারণেও ব্যহত হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। প্রকল্প এলাকায় বাইরের শ্রমিকদের থাকার জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ১২টি ডরমেটরির নির্মাণ কাজ স্থানীয়দের বাধায় আটকে আছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ইপিজেডের সব শ্রমিক স্থানীয়ভাবে যোগান দেয়া সম্ভব নয়। এখানে কারখানা চালাতে হলে বাইরে থেকে শ্রমিক আনতে হবে। আর সেক্ষেত্রে তাদের থাকাখাওয়ার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা আবশ্যক। বাধা না পেলে এতদিনে ছয়টি ডরমেটরি নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে যেত বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।
নতুন গন্তব্যে ইয়ংওয়ান
কেইপিজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) হাসান নাসির জানান, ভিয়েতনামে ৩০০ একর জায়গা সে দেশের সরকার বিনামূল্যে ইয়াংওয়ানকে দিয়েছে ১০ বছরের মধ্যে কাজ শুরুর শর্তে। তিন বছরের মধ্যেই সেখানে কারখানা চালু হয়ে এখন পুরোদমে উৎপাদন চলছে। এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র সে দেশের সরকারি সহযোগিতার কারণে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “অথচ এসব কারখানা এখানেই (চট্টগ্রামে) হওয়ার কথা ছিল।”
ঢাকায় কোরিয়ান দূতাবাসের একজন বাংলাদেশী কর্মকর্তা জানান, কেইপিজেডের প্রস্তাবিত আইটি পার্কে কারখানা চালু করতে পাঁচ বছর ধরে অপেক্ষা করছে স্যমসাং। এখন তারা মিয়ানমারে জায়গা খুঁজছে। মিয়ানমার সরকার প্রস্তাব জমা দেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব অনুমতি আর জ্বালানির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। হতাশার সুর ওই দূতাবাস কর্মকর্তার কণ্ঠেও, “বাংলাদেশই ছিল সবার আগ্রহের কেন্দ্রতে। এখানকার আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি পেয়েই কোম্পানিগুলোকে আমরা আশ্বস্ত করেছিলাম। অথচ এখন প্রাপ্তি কেবল লজ্জা।”
কি বলছে মালিকপক্ষ?
এতোকিছুর পরও হাল ছেড়ে দিচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ইয়ংওয়ানের কর্ণধার খিয়াক সাং গত বছরের জুনে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা তাঁদের নেই। সৃষ্ট বিভিন্ন জটিলতা, হয়রানি আর দুর্ভোগের জন্য কারও বিরুদ্ধে তাঁদের কোন অভিযোগ নেই- এমন মন্তব্য করে খিয়াক সাং প্রতিশ্রুত সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে অন্তত ৪০ হাজার বাংলাদেশীর নিশ্চিত কর্মসংস্থান ত্বরান্বিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
মৌখিকভাবে কিছু না বললেও বিষয়টি নিয়ে ইয়ংওয়ান আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। তেমন কিছু হলে সেটা যে দেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক কিছু হবে না তা বলাই বাহুল্য। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের প্রথম বেসরকারি ইপিজেডটির কর্মকাণ্ডে গতি আনতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কার্যকর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছেন বিনিয়োগসংশ্লিষ্টরা।