বেসরকারি চারটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন ওয়াহিদুর রহমান নামে এক ব্যবসায়ী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ লক্ষ্যে দুদক উপ-পরিচালক জুলফিকার আলীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধানী টিম গঠন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে কমিশন সূত্র। টিমের বাকি সদস্যরা হলেন, সহকারী পরিচালক মশিউর রহমান ও উপ-সহকারী পরিচালক উমর ফারুক।
দুদক সূত্র জানায়,ওয়াহিদুর রহমান নামের ওই প্রতারক ঋণের নামে বেসিক ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছেন।পরে তিনি চিকিৎসার নামে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
ওয়াহিদুর রহমান বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে বেসিক ব্যাংক থেকে ৭৬৭ কোটি টাকা,আইসিবি ইসলামী ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে ১২৪ কোটি, সিটি ব্যাংক থেকে ৬ কোটি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন।
এর বেশির ভাগ টাকাই তিনি ভুয়া ও বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাত করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা, শান্তিনগর এবং গুলশান শাখা থেকে ওয়াহিদুর রহমান নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছেন।তিনি অটো ডিফাইন নামের প্রতিষ্ঠানের নামে শান্তিনগর শাখা থেকে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।যা পরে সিআর এন্টারপ্রাইজের নামে হস্তান্তর করা হয়। দুটি প্রতিষ্ঠানেরই মালিক ওয়াহিদুর রহমান হলেও ঋনের নথিতে ভিন্ন ভিন্ন নাম দেখানো হয়েছে।
এছাড়া এবি রাশেদ নামে এক কর্মচারীকে মালিক বানিয়ে এবি ট্রেড লিংক নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে ৬৭ কোটি টাকার ঋণ নেন তিনি। আর মা টেক্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে গুলশান শাখা থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৮০ কোটি টাকা।কাগজপত্রে এর ভূয়া ঠিকানা দেখানো হয়েছিল বলে পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে।
এদিকে অটো ডিফাইন ঋণ খেলাপি প্রমাণিত হওয়ার পর নিউ অটো ডিফাইন নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান খোলা হয়। যার মালিকানা দেখানো হয় আসমা খাতুন নামে এক মহিলাকে।এই প্রতিষ্ঠানের নামেও শান্তিনগর শাখা থেকে ৯০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়।
এছাড়া ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের নামে শান্তিনগর শাখা থেকে ১৫২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি। যা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বংশাল শাখা থেকে প্রায় শত কোটি টাকা নিয়ে আত্মসাত করেন ওয়াহিদুর রহমান । তিনি বিভিন্ন ধরনের ১০টি প্রতিষ্ঠানের নামে ভূয়া নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে ওই শাখা থেকে শতাধিক কোটি টাকা নিয়ে আর ফেরত দেননি।
এদিকে কর্মচারী রাসেলের নামে সিটি ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে হলোগ্রাম ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ৫ কোটি ও তার কর্মচারী এবি রাশেদের নামে খোলা অপর একটি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ১ কোটি টাকা।যার পুরোটাই এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে
এছাড়া কৃষি ব্যাংকের বনানী শাখা থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ১২৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি।এর মধ্যে ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের নামে ৫৪ কোটি ৫৮ লাখ, অটো ডিফাইনের নামে ৩৬ কোটি ৪৭ লাখ এবং ফিয়াজ ট্রেডিংয়ের নামে ৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।সব ঋণই ইতিমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি থেকে ওয়াহিদুর রহমানের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নামে নেয়া ঋণের মধ্যে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।এর মধ্যে অটো ডিফাইনের নামে ১ কোটি ৯৩ লাখ ও বাকি ৪৭ লাখ টাকা নিজের নামে নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণও নিয়মিত শোধ না করায় এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনে এসব ঋণ আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মন্তব্য করা হয়েছে।গ্রাহককে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে নজিরবিহীন বেআইনি সুবিধা দেয়ার তথ্যও উঠে এসেছে ওই সব তদন্ত প্রতিবেদনে। আর এতে ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের উদাসীনতার প্রমাণও পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের আলোকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
তথ্যসূত্রঃ অর্থসূচক