‘সাপকে মারলে সাপের বাচ্চা এক সময় প্রতিশোধ নেয়। আর তাই তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হয় না। বাচ্চা দু‘টির উপর জিন আছর করছিল। তাই তাদের ঘার মটকে মাইরা ফেলছি। আবার তাদের মায়ের শাড়ীর নিচে রেখে আসছি।’
কেরানীগঞ্জের একই পরিবারের চারজনের মধ্যে দুই শিশুকে খুন করার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে গ্রেফতারকৃত জনি। এর আগে চারখুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতারকৃত সাতজনকে সংবাদকর্মীদের সামনে আনা হয়। তারা হলেন- রফিক (সুমন), সুমন, জনি, আব্দুল মজিদ, জনির মা সাহিদা আক্তার আম্বিয়া, রাণী ও মুক্ত।
তিনি বলেন, ‘বাচ্চা দু’টি কান্নাকাটি করতাছিল। রঞ্জি (নিহত সাজুর স্ত্রী) বলছিল বাচ্চা দুইটারে মারিস না। ওদের ছেড়ে দে। মায়া মহব্বতের কারণে বাচ্চা দুইডারে কেউ মারতে পারতাছিল না। তখন তারা খাওন (ইয়াবা) খেয়ে টাল। আর তখনই বাচ্চা দুইডার উপর জিন আছর করল। আমি দেখতে পাইলাম। জিন কইল ঘার মটকে মেরে ফেল। আর তাই ঘার মটকে বাচ্চা দুইটারে মেরে ফেলাইছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস বাচ্চা দুইটা মরে নাই। তারা এক প্রাণ। আর তাই তাদের এক কাপর দিয়ে বাধছিলাম। তয় ওরা কেউ পারে নাই। আমি মাইরা দেহায়া দিলাম।’
জনি আরো বলেন, ‘সাজুর বউরে আমি বইন মানছি। আর সাজু কোরআন অবমাননা করে আমার বউয়ের লগে অবৈধ সম্পর্ক করল। এই কারণে ওরে শেষ কইরা দিছি।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে জনি বলেন, ‘জীবনে অনেক ডাকাতি করেছি। কতটি সংখ্যা মনে নেই। ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে ডাকাত রফিক (সুমন) আমারে ফোনে ডাইকা নিয়া যায়। তখন রফিক ক্ষিপ্ত ছিল। ওই বাসায় সে ছাড়া তখন ডাকাত রফিক, আফসানা, সিএনজি সুমন ও নাসির ছিলেন। সাজুকে বেঁধে রেখে সাজুর স্ত্রী ও ছেলে মেয়েকে অন্য রুমে আটকে রাখে তারা।’
জনি আরো বলেন, ‘পরে সেখানে তারা খাওন (ইয়াবা) খেয়ে সাজুর উপর নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে সাজুকে সবাই ধরে রাখে, আমি ও ডাকাত রফিক মিলে সাজুকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করি।’
সাজুর স্ত্রী রঞ্জিকে কেন হত্যা করা হলো এ প্রশ্নের জবাবে জনি ও অপর আসামি সিএনজি সুমন বলেন, সাজুকে বেঁধে মারধর করার পরও সাজুর স্ত্রী রঞ্জি কোনো রকম কান্নাকাটি না করায় বা তাদের পা ধরে প্রাণ ভিক্ষা না চাওয়ায় সাজুর স্ত্রী রঞ্জির উপর তাদের রাগ হয়। আর তাকে বাঁচিয়ে রাখলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে বা প্রতিশোধ নিতে পারে বলেই রঞ্জিকে হত্যা করা হয়।
অপর গ্রেফতারকৃত আসামি সিএনজি সুমন বলেন, তিনিই সাজুকে ওই বাসা ভাড়া করে দিয়েছেন। কিন্তু সাজু ডাকাত সুমনের একটি মোটরসাইকেল চুরি করে। আর নাম দেয় তার। তখন ডাকাত সুমন তার উপরও অনেক রাগ করেছিল। একপর্যায়ে জানতে পারলেন যে, সাজুই মোটরসাইকেল চুরি করেছে। এছাড়া ডাকাত সুমনের স্ত্রী’র সঙ্গে সাজুর অবৈধ সম্পর্ক থাকায় ডাকাত সুমন সাজুকে শেষ করার পরিকল্পনা করেন। আর ঘটনার দিন তাকে ফোন করে ডাকাত সুমন বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর সবাই মিলেই হত্যা করে চারজনকে।
এদিকে, শুক্রবার দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) হাবিবুর রহমান বলেন, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মালামাল ভাগবাটোয়ারা এবং নিজেদের দলের ভেতরের অন্য পুরুষ সদস্যের স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের জেরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে সাজু আহমেদ স্ত্রী ও সন্তানসহ চারজন খুন হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘নিহত সাজু আহমেদ অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি একটি ডাকাতি দলের সক্রিয় সদস্য। বিভিন্ন সময় তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি করত। এই লুন্ঠিত মালামাল ভাগবাটোয়ারা নিয়েই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এই জন্য রফিক ও জনি তার উপর ক্ষিপ্ত হয়। এছাড়াও রফিকের (সুমন) প্রথম স্ত্রী লাকী এবং জনির স্ত্রীর সঙ্গে নিহত সাজুর অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর রফিক ও জনি পরিকল্পনা করে কয়েকজনকে নিয়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে সাজু আহমেদসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করে।’
‘হত্যার আগে সাজুর স্ত্রী রঞ্জির সঙ্গে মোবাইল ফোনে সুমন কথা বলে। ফোনে কথা বলে সাজুর অবস্থান নিশ্চিত হয় তারা। সে বাসায় আছে তা নিশ্চিত হওয়ার পর জনি, সিএনজি সুমন, নাসির, আফসান ও ডাকাত সুমন সাজুর বাসায় যায়। রাত ১১টার দিকে সাজুর স্ত্রী রঞ্জি, ছেলে ইমরান ও মেয়ে সানজিদাকে পাশের কক্ষে আটকে রাখে। এরপর সাজুকে হাত-পা-মুখ বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ইয়াবা সেবন করে। রাত ২টার দিকে সাজুর স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পর তার দুই সন্তানকেও শাড়ী দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।’ বলেন এসপি।
তিনি আরো বলেন, ‘হত্যার আগে সবাই ইয়াবা সেবন করেছিল। তারা সবাই মাদকাসক্ত ছিল। অপরাধ করে নিরাপদে থাকার জন্য তারা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কলাকান্দি এলাকার ওই বাসাটি ভাড়া নেয়।’
তিনি বলেন, ‘গ্রেফতারকৃতরা ডাকাতি, মোটরসাইকেল চুরি এবং ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। সর্বশেষ তারা নবাবগঞ্জের চুরাইন বাজারে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে।’
এই ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত সাজুর ভাই বশির উদ্দিন। খবর শীর্ষনিউজ।