সেই অনেক আগে থেকেই ‘প্রবাসী’ শব্দটা শুনলে মনের মাঝে কোনো এক দীন-দুঃখী মানুষের চেহারা ভেসে উঠতো, নিজ দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষটার প্রতি করুণা হতো বরাবরই। কালের পরিক্রমায় আমিও আজ তাদের একজন। প্রবাসী শব্দটা শুনলে এখন মনে হয় খুবই আপন কেউ, কেউ এখন প্রবাসী নিয়ে কোনো খারাপ কথা বললে কটূ কথা বললে সরাসরি বুকে এসে লাগে। আগে থেকেই খেয়াল করেছি কিছু সুশীল ভাইব্রাদারেরা প্রবাসীদের খোঁচা দিয়ে নির্মল আনন্দ নেন, সুশীল থেকে সুশীলতর হয়ে উঠেন, কয়েকদিন ধরে ভাবছি কিছু কথার জবাব দেয়ার দরকার।
ভাইয়ের প্রতি যথাবিহিত সম্মানপূর্বকই বলছি, এক ভাইয়ের স্ট্যাটাস পড়ে মনে হয়েছিল প্রবাসীরা বুঝি প্রবাসে শুধু হার্ডওয়্যারই ডাউনলোড করেন, প্রবাসীদের সেকেন্ড জেনারেশন এখন কী কী করে সেটা অন্য একদিন আলোচনা করবো আজ স্ট্যাটাসের পরের অংশে আলোচনা করবো সেটা নিয়ে খোঁচা দেয়াটা কতটুকু যৌক্তিক সে বিষয়ে। আরেক বিখ্যাত ব্লগার ভাই কয়েকদিন আগে যা তা ভাষায় প্রবাসীদের নিয়ে বলেছিলেন যে, প্রবাসীরা নাকি কামলা ক্যাটাগরির মানুষ। তারা বিদেশে নিজের দেশের লোকদের সম্মান দিতে জানে না। সেটা নিয়েও আলোচনা আছে; আরেক সম্মানিত বড় ভ্রাতা শ্লেষভরে দেশপ্রেমিক প্রবাসীদের দেশে ফিরে আসার আবেদন জানালেন, আজ কথা হবে সেটা নিয়েও!!
প্রথমত, বিদেশে কেউ সাধে যায় না, ঠেকায় পড়েই যায়, দেশে তেমন কিছু করতে না পারলে। যেমন আমার কথা বলি আমার মতো অপদার্থ একজন মানুষ দেশের কোনো উপকার করা দূরে থাক দেশের বোঝাই ছিল, দেশ থেকে চলে এসে আমি একজন বেকারত্ব কমিয়েছি, দেশে জনসংখ্যার চাপ কমিয়েছি। দেশে থাকলে হয়তো হতাশা থেকে দুর্নীতিবাজ হতাম, মানুষের টাকা মেরে খেতাম সেই সম্ভাবনা কমিয়েছি। এতে কি দেশের কোনো অপকার হয়েছে নাকি উপকার হয়েছে? আমার মনে হয় এটা কেবল উন্নাসিক বাঙালিদেরই সমস্যা, সমুদ্র পাড়ি দিলে জাত যাবে এমন কোনো সংস্কার এখনো তাদের মাঝে কাজ করে কিনা আমি ঠিক নিশ্চিত না, তবে ইতিহাস কিন্তু বহু মাইগ্রেশনের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ হয়েছে- সেই কোথা থেকে মোঘলরা এই উপমহাদেশে এসেছে, পৃথিবীর জাতিগত মানচিত্র পরিবর্তিত হয়েছে সময়ের সাথে সাথে; নতুন এলাকা খুঁজে বের করার জন্য অভিযাত্রীদের কিন্তু সরকারিভাবে পুরস্কৃতই করা হয়েছে। আমি ভাস্কো-দা-গামা কিংবা কলম্বাসের কথা বলছি, তাদের পুরস্কৃতই করা হয়েছিলো, কেউ বলেনি তারা পরবাসে যাওয়ার পথ আবিষ্কার করেছে তারা দেশদ্রোহী। আর হ্যাঁ তারাই ইউরোপের বর্তমান সমৃদ্ধিরও নায়ক!! (আমি ব্রেনড্রেইনের পক্ষে সাফাই গাইছি না, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সেইসব মেধাবীরা যারা সরকারি টাকায় বুয়েট/মেডিক্যালে পড়েছেন তাদের অবশ্যই সেই ঋণশোধ করা উচিত, আমি আমার মতো আবর্জনার কথা বলছি।)
এবার আসি হার্ডওয়্যার ডাউনলোডের কথায়, কামলা দেয়ার কথায়। এই একটা টপিক নিয়ে তারা যখন খোঁচা দেন তখন জাতি হিসেবে আমাদের বাঙালিদের এই দীনতাহীনতার কারণ আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে। আর সেই কারণ হচ্ছে কাজের প্রতি এই সম্মানহীনতাটা; আমাদের এই বাঙালি জাতি ভিক্ষা করে খেতে লজ্জাবোধ করে না, দুর্নীতি করতে লজ্জা পায় না, অনলাইনে নানা কৌশলে অর্থ উপার্জনে লজ্জ পায় না, তাদের লজ্জ্বা কাজে। আহারে লাজুকলতা আমার!
এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার, যে ভাই প্রবাসীদের কামলা বলেছিলেন আমি যতদূর জানি তার সেলফোনটা কোনো এক প্রবাসীর দেয়া! আমেরিকায় এসে যা দেখলাম এই দেশে চাইলে বসে বসে খাওয়া যায়, সরকার খাওয়ায়, এই ভাতাকে স্থানীয়রা বলে ‘ফুডস্টাম্প’, এই ফুডস্টাম্পের আওতায় সন্তানকেও আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত সরকার পালে, অথচ এই দেশে এই ফুডস্টাম্পকে লোকজন ভয়াবহ হীন দৃষ্টিতে দেখে। যারা ফুডস্টাম্প তোলে তাদেরকে সমাজ খুব নিকৃষ্ট ভাবে; এই দেশে বসে বসে খাওয়া লজ্জার, কিন্তু কেউ যদি ঝাড়ু দিয়ে কিংবা হার্ডওয়্যার ডাউনলোড করে ট্যাক্স দেয় তবে সে এইদেশের সম্মানিত নাগরিক, তাহলে বলুন উন্নতি কাদের করা উচিত? তাদের নাকি আমাদের বাঙালিদের?
এই দেশে প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষ এইসব অড জব করে পড়াশোনা করে, একদিকে ইঞ্জিনিয়ার হতে থাকে অন্যদিকে পিতজা বানায় কিংবা ট্যাক্সি চালায়; আর আমাদের বাংলাদেশে কোনো কলেজছাত্র রিকশা চালাচ্ছে খবর পাওয়া গেলে তাকে নিয়ে পত্রিকায় আর অনলাইনে মারহাবা সাবাশ বলে হাহাকার পড়ে যায়, উন্নত দেশের মানুষ ছোট কাজ করতে করতে বড় হয় বলেই তাদের জীবনবোধ স্পষ্ট, তারা যখন আগাতে থাকে তখন সবকিছু পেছনে ফেলে তেড়েফুঁড়ে আগায়, আপনিই বলুন উন্নতিটা কাদের করা উচিত?
যে ভাই প্রবাসীদের দেশে ফিরে আসার কথা বলেছিলেন তাকেও আরেকটু ভাবতে অনুরোধ করছি; বিভিন্ন দেশে কমপক্ষে ৫০ লাখ প্রবাসী আছেন তারা সবাই দেশে ফিরে এলে দেশের জনসংখ্যা কত হবে? তাদের চাকরি বাকরির ব্যবস্থা কে করবে?? নাকি তাদের খাওয়া পড়ার ব্যবস্থা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার করবে? বিহারী ক্যাম্পের মতো কোন শরণার্থী ক্যাম্প বানাবেন এমন কিছু ভেবে রেখেছেন নাকি?
একেবারে শেষ কথা, যদি প্রবাসীদের দেশপ্রেমের কথা বলেন তাহলে যা বলতেই হয়… প্রবাসীরা দেশের কোনা উপকার একেবারে না ই করুক তবু তারা বুক মাথা উঁচু করে বলতে পারে তারা এতদূর থেকে দেশের অন্তত কোনো ‘অপকার’ করছে না, তারা ঘুষ-দুর্নীতি করে দেশকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে না, অন্যায় নৈরাজ্যের পেছনে তাদের কোনো হাত নেই… আপনারা দেশের লোকজন যদি এত দেশপ্রেমিকই হবেন তাহলে দেশের আজ এই অবস্থা কেন,? প্রবাসীরা এসে তো আপনাদের যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে না… বলতে পারেন আপনি নিজে সৎ দেশপ্রেমিক অর্থাৎ আপনি নিজে কোনো দুর্নীতি করেন না, তাহলে আমরা আরো বলতে পারি আপনি এত দেশপ্রেমিক হয়ে দেশে থাকলেন তাহলে অন্যায় প্রতিরোধ কেন করেন না…?
পুনশ্চঃ যারা অ্যাম্বেসি থেকে ভিসা রিফিউজড হয়ে এসে ‘দেশই ভালো, বিদেশে যায় কামলারা’ টাইপের স্ট্যাটাস দেন তাদের বিষয়ে এই স্ট্যাটাসে কোনো আলোচনা করা হয়নি।
লেখকঃ আমেরিকা প্রবাসী।