Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ভয়াবহ রাজস্ব লিকেজে জড়িয়ে পড়েছে অধিকাংশ বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশে রাজস্ব অনিয়ম রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কর্তৃপক্ষ। বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানির পর অধিকাংশ রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানই কালোবাজারে পণ্য বিক্রির গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত। কাস্টমস বন্ড নিয়ন্ত্রিত মোট ৫ হাজার ৯৮৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২ হাজার ৯শ’ প্রতিষ্ঠানই সরকারের বড় অংকের রাজস্ব আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ২ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা বলে দাবি বন্ড কর্তৃপক্ষের।
প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে- এমন উদ্বেগজনক তথ্য স্বীকার করে সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রয়োজনীয় জনবল এবং লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে বন্ড প্রতিষ্ঠানের সঠিক তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় ৬ হাজার প্রতিষ্ঠান তদারকিতে আছে মাত্র ১৬৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। যদিও মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ২৮৪। এত স্বল্পসংখ্যক জনবল ও সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এত বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে নজরদারি খুবই দুরূহ। আর এতে রাজস্ব লিকেজ বেড়ে গেছে ভয়াবহভাবে। বন্ড লাইসেন্সধারীদের অবৈধ সুবিধা দিয়ে একশ্রেণীর কাস্টমস কর্মকর্তা কোটিপতি হয়ে গেছেন- এটা ওপেন সিক্রেট।
1_134256তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, বন্ড প্রতিষ্ঠানে কঠোর নজরদারি ও তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি গত কয়েক মাসে বকেয়া রাজস্ব আদায়ে রাজস্ব খেলাপি ১৮১ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অপরিচালনযোগ্য বা জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কাস্টমস আইনের ২০২ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে ৬ শতাধিক প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করার কারণে রাজস্ব ফাঁকি এখন অনেক কমে এসেছে। বকেয়া রাজস্ব আদায়েও অগ্রগতি হয়েছে।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) কাস্টমস বন্ড কমিশনারের পাঠানো এক গোপনীয় প্রতিবেদনে এমন সব তথ্য আছে যা উদ্বেগজনক। মাত্র এক বছরের বিশেষ তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী নথিপত্রে কার্যক্রম রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন এমন ২১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে। এ নিয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। এছাড়া রাজস্ব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বন্ড কমিশনারেটের কঠোর অবস্থান তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপুল অংকের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েও তা পরিশোধ না করায় এ পর্যন্ত ১৮১টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কাস্টমস আইনের ২০২ ধারায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্থগিত করে ৬০১টি অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বন্ড কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে। অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় এ পর্যন্ত বন্ড লাইসেন্স সাসপেন্ড করা হয়েছে ১ হাজার ৬০৯টি প্রতিষ্ঠানের। এছাড়া সরকারের পাওনা আদায়ে সার্টিফিকেট মামলা দায়ের হয়েছে ৬০১টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে বন্ড কমিশনার ড. মোঃ সহিদুল ইসলাম জানান, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান শনাক্তকরণ, শুল্ককর ফাঁকি প্রতিরোধে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায়। সব ক্ষেত্রেই তদারকি ও জবাবদিহিতা বাড়ানো হয়েছে। এতে বিপুল অংকের রাজস্ব ফাঁকি ধরা পড়ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে সব বন্ড প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া শত শত প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর অডিটের বাইরে রয়ে গেছে, যা রাজস্ব লিকেজের সুযোগ সৃষ্টি করছে।
সূত্র জানিয়েছে, বন্ড কমিশনারেটের তদন্ত চলমান থাকায় আশংকা করা হচ্ছে, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ শতাধিক হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন কেন এত গুরুতর একটি বিষয় ধরা পড়েনি। মূলত বছরের পর বছর অডিট না করার সুযোগ নিয়ে এবং একশ্রেণীর বন্ড কর্মকর্তার যোগসাজশে অস্তিত্বহীন হয়েও এসব প্রতিষ্ঠান রফতানির নামে শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানি করে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এখন এ বিষয়েও তদন্ত শুরু হচ্ছে বলে সূত্র দাবি করেছে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বিতর্কিত বন্ড কমিশনার হাফিজুর রহমানের সময় ঢাকা বন্ড কমিশনারেট দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। এ সময়ে এমন কোনো অনিয়ম নেই যা বন্ড কমিশনারেটে হয়নি। সরেজমিন কারখানা ও মেশিনারিজ পরিদর্শন করে সঠিক পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এমন প্রতিবেদনে শত শত কোটি টাকার শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানির জন্য কমিশনার হাফিজুর অর্থের বিনিময়ে গণহারে বন্ড লাইসেন্স ইস্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এখন তদন্তে দেখা যাচ্ছে, সে সময়ের লাইসেন্স পাওয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই বাস্তবে অস্তিত্বহীন। সরকারের বিশাল অংকের রাজস্ব ক্ষতি করে নিজের আখের গুছিয়ে এই দুর্নীতিবাজ কমিশনার এখন বিদেশে চলে গেছেন। শিক্ষা ছুটির মেয়াদ শেষ হলেও তিনি দেশে ফেরেননি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নারী নির্যাতন ও জালিয়াতিসহ বহু অভিযোগে একাধিক কমিটি তদন্ত করছে। দুর্নীতি দমন কমিশন গত সপ্তাহে হাফিজুর ও তার স্ত্রীর সম্পদ বিবরণী তলব করেছে।
এদিকে বর্তমান কমিশনার ড. সহিদুল ইসলাম যোগ দিয়েই বন্ড কমিশনারেটের ইমেজ পুনরুদ্ধার করে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। সীমিত জনবল নিয়েই তিনি বন্ড কমিশনারেটের সর্বত্র তদারকি ও জবাবদিহিতা বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। ফলে রাজস্ব আত্মসাৎকারীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
একটি নমুনা : ঢাকাস্থ সাভার ইপিজেডের বন্ড সুবিধাভোগী শতভাগ রফতানিমুখী একটি প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধায় ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা মূল্যের উন্নতমানের কাপড় আমদানি করেছে। কিন্তু কাগজপত্রে ভুয়া রফতানি দেখিয়ে ৮০ শতাংশ কাপড়ই বিক্রি করা হয়েছে কালোবাজারে। অনিয়ম ধরা পড়ার পর সরকারের পাওনা আদায়ে দাবিনামা জারি করা হলে এক পর্যায়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। শাস্তি হিসেবে বন্ড লাইসেন্স বাতিল করা হলে আবার অন্য নামে লাইসেন্স নিয়ে নতুন আরেকটি প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। বিষয়টি জানা ছিল না কাস্টমস বন্ড কর্তৃপক্ষের। এক পর্যায়ে পরিচালকদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি আবারও বড় অংকের রাজস্ব অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। এমন ঘটনা আছে ভূরি ভূরি। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট এখন এই অনিয়ম বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া গেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ১৮১টি বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান কাগজপত্রে থাকলেও বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রাথমিক তদন্তে এমন তথ্য উদ্ঘাটিত হলে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। এখন শুরু হয়েছে ব্যাপকতর তদন্ত।
একই সঙ্গে চাহিদাবহির্ভূত মাত্রাতিরিক্ত আমদানি প্রাপ্যতার সুযোগ নিচ্ছে এ ধরনের আরও বহু বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের তদন্তে আরও দেখা গেছে, শত শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এক পর্যায়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে শত শত প্রতিষ্ঠান। নিয়মিত অডিট কার্যক্রম ও তদারকি না থাকায় এভাবে সরকারের অর্থের রীতিমতো হরিলুট হচ্ছে। আর এই অবৈধ কাজের সুযোগ করে দিয়ে বন্ড কর্মকর্তারা ফুলেফেঁপে উঠছেন।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ : বন্ড কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রয়োজনীয় জনবল স্বল্পতা ও তদারকির অভাবে বন্ড কমিশনারেটের অধিক্ষেত্রাধীন কিছু প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠানের হালনাগাদ নিরীক্ষা দীর্ঘদিন ধরে অসম্পন্ন আছে। হালনাগাদ নিরীক্ষা অসম্পন্ন ও দাবিনামার কারণে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করা হলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ প্রায়ই কারণ দর্শাও নোটিশের জবাব দেন না এবং নির্ধারিত শুনানিতে উপস্থিত থাকেন না। এ অবস্থায় গত ১ বছরে ১৮১টি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পরিচালকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অপরিচালনযোগ্য করায় অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে এবং বিদ্যমান অনিয়ম মামলা দ্রুত শুনানির মাধ্যমে আইনানুগ নিষ্পত্তি করা সহজতর হচ্ছে। সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অস্তিত্ব বিলোপের সুযোগ সীমিত হয়েছে।