কিউবার কিংবদন্তি নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখি নি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি…।” বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনের সাথে অনেকেরই দ্বিমত থাকতে পারে। মুজিবের উত্তর প্রজন্ম তাঁর নীতি-আদর্শকে কতোটা ধরে রাখতে পেরেছে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু নয় মাসের যুদ্ধে একটা দেশকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার কাণ্ডারি মানুষটিকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করাটা জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের অনেক বড় একটা দৈন্যতাকেই কেবল প্রকট করে ফুটিয়ে তোলে। অকাট অন্ধ বিরোধী ছাড়া এমন নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে দেশের সাধারন মানুষের যেমন কোন সমর্থন ছিল না, তেমনিভাবে একজন প্রতিশ্রুতিশীল বিশ্বনেতার করুণ পরিনতি মেনে নিতে পারেন নি সমসাময়িক বিশ্বের অন্য নেতৃবৃন্দও। ‘৭৫ পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ক’জন রাষ্ট্রদূত বাসসকে বলছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা।
’৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত সে হত্যাকাণ্ডের জন্য নিজেকে অভিযুক্ত করে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কয়েক বছর পর মিশরে বাংলাদেশের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আসাদুজ্জামান সে দেশের রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর পরিচয়পত্র পেশ করতে গেলে আনোয়ার সাদাত (যিনি নিজেও পরবর্তীতে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন) বলেছিলেন, “তোমরা আমার প্রিয়বন্ধুকে হত্যা করলে! তাও আবার আমারই দেয়া ট্যাংক ব্যবহার করে!…আমি নিজেকে এখন অভিশাপ দেই, কেন আমি তোমাদের ট্যাংক দিয়েছিলাম?” উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধু সরকারের সেনাবাহিনীকে সমৃদ্ধ করার অংশ হিসেবে আনোয়ার সাদাত উপহারস্বরূপ একটি ট্যাংক বহর পাঠান।
পরবর্তীতে মিশরে কাউন্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশের কূটনীতিক সি এম শফি সামী মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্টের এই ঐতিহাসিক মন্তব্য স্মরণ করে বলছিলেন, “তাঁর (মিশরের রাষ্ট্রপতি) কথায় সেদিন লজ্জায় সবার মাথা কাটা যাচিছল।”
সেসময় যুক্তরাজ্যে দায়িত্ব পালনরত সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরী এক বিদেশীর লেখা একটি চিঠির কথা স্মরণ করছিলেন, “আমি একজন সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিক। আমি রাজনীতি বুঝি না, এমনকি আমার দেশেরটাও না। কিন্তু আমি কি জানতে পারি, কি অপরাধ করেছিলো বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার এবং তার আত্মীয়-স্বজন। এমনকি নয় বছরের (দশ) ছোট্ট রাসেলের কি অপরাধ ছিল? তাদের এই করুণ পরিণতি বরণ করতে হলো কেন?”
এক বছর বাদেই ফারুক চৌধুরী সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান। ইউএই’র তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের সাথ সৌজন্য সাক্ষাতে করতে গিয়েও একইরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে, “আমার বন্ধু মুজিবকে তোমরা হত্যা করলে কেন?”
প্রায় ২৯ বছর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দুর্ভাগ্যজনক বিয়োগান্তক অধ্যায় সংঘটিত হবার সময় রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ফারুক ঢাকাতেই ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে দায়িত্ব পালনকালে বিদেশীদের অনেকেই তাঁর (মোস্তফা ফারুক) কাছে বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে স্মরণ করে তাঁর নির্মম পরিনতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বঙ্গবন্ধু জীবনের এহেন পরিসমাপ্তির জন্য কেউ কেউ বাংলাদেশীদের ‘অকৃতজ্ঞ’ ও ‘বর্বর’ জাতি বলেও বিরূপ মন্তব্য করেন।
মোস্তফা ফারুকের মনে পড়ছিল ‘৭৫-এ ঢাকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইউরি নামের এক ভদ্রমহিলার কথা। মি. ফারুক বলছিলেন, “৯৬ সালে যখন আমি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে রাশিয়ায় যাই তখন কূটনীতিক ইউরি মস্কোয় বাংলাদেশ দূতাবাসের দেয়া একটি সংবর্ধনায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ আমি (মোস্তফা ফারুক) বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার পরে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিলো তাদের কর্তৃত্বে দায়িত্ব পালন করেছিলাম!…পরবর্তীতে যেকোনভাবেই হোক ইউরি একদিন বাংলাদেশ দূতাবাসে এলে আমি তাঁর কাছে ’৭৫-এর অবস্থা এবং সেসময় আমার অবস্থান ও করণীয় ব্যাখ্যা করি।”
মোস্তফা ফারুক আরও জানান, “ইউরি যাবার সময় মস্কোতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের আঙ্গিনায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি আপেল গাছের চারা রোপণ করেন।” ২০০২ সালে মস্কো সফরে গিয়ে সে চারাগাছটিকে পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষ হিসেবেই দেখে এসেছেন আরেক কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির ’৭৫ পরবর্তীকালে একাধিকবার কূটনৈতিক সফরে মধ্যপ্রাচ্য যান। তিনি বলেন, ওই সময় আরব নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে যারা আরব লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁদের সাথে তাঁর আলাপচারিতায় ঘুরেফিরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও তাঁর নির্মমভাবে শাহাদাতবরনের বিষয়টি উঠে আসতো।
’৭৫ সালে ফ্রান্স রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সিএম শফি সামী। তিনি বলছিলেন প্যারিসের কথা, “ফ্রান্সের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও মানবাধিকার কর্মী আন্দ্রেয় ম্যালরক্সসহ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন) মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে সহায়তাকারী ফ্রান্সের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশেরই অস্ত্রধারীদের হাতে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হবার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ফ্রান্সের প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী, বাংলাদেশের বিশিষ্ট বন্ধু সাবেক আইনজ্ঞ এবং ক্যাথলিক গির্জার পাদ্রী মাইটার স্মিডলিনসহ পপুলার রিপাবলিকান মুভমেন্টের অনেক নেতা প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাসে টেলিফোন করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অপরাধ উল্লেখ করে শোক ও সমবেদনা জানান।”
[বাংলা টেলিগ্রাফ, ঢাকা ব্যুরো কর্তৃক সম্পাদিত ও ঈষৎ পরিমার্জিত]