তুরস্কের বিভিন্ন পত্রিকায়-টিভি চ্যানেলে বেশ গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে শাহেন শাহর গবেষণার খবর। সে দেশের ইলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রনিকস ও যোগাযোগ প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন এই প্রবাসী বাংলাদেশি।
কী তাঁর গবেষণার বিষয়
শাহেন শাহ বুঝিয়ে বললেন, ‘ভূমিকম্প, বন্যা বা এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না। ২০২৩ সালে তুরস্কে যখন ভয়াবহ ভূমিকম্প হলো, তখনো আমরা এ রকম পরিস্থিতি দেখেছি। আবার গত বছর বাংলাদেশের বন্যার সময়ও দেখেছি, ফেনীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগের সমস্যার কারণে উদ্ধারকাজ কঠিন হয়ে পড়েছিল। ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষককে সঙ্গে নিয়ে এ সমস্যার একটা সমাধান আমি খুঁজেছি।’
মূলত একাধিক ড্রোনের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সচল রাখার একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন শাহেন শাহ। তিনি বলেন, ‘ধরা যাক, একটি বেস স্টেশন আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কাজ করে। আমাদের মডেল অনুযায়ী, পাঁচটি ড্রোন এই একটি বেস স্টেশনের কাজ করবে। আমার এই আবিষ্কার বিখ্যাত ড্রোনস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে।’
তুরস্কের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণা পরিষদ এবং ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় পরিচালিত এই প্রকল্পে প্রাথমিক সফলতা পাওয়া গেছে। এখন এটি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে।
জানিয়ে রাখি, ইলদিজ তুরস্কের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১১ সালে। প্রকৌশল শিক্ষায় এর বেশ সুনাম আছে। শাহেন শাহ শুধু যে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এআই অ্যান্ড নেক্সট জেনারেশন ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন ল্যাবের (এএনডব্লিউসিএল) পরিচালকের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। ছোট-বড় মিলিয়ে ছয়টি গবেষণা প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করছেন তিনি। ১২ জন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ছাড়াও বেশ কয়েকজন স্নাতকপড়ুয়া শিক্ষার্থী শাহেন শাহর অধীনে গবেষণা করছেন।
কেমন করে ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছালেন বাংলাদেশের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশলের স্নাতক শাহেন শাহ?
শুরু থেকেই সেরা
২০০৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে জিপিএ–৫ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন শাহেন শাহ। তখন থেকেই তাঁর লক্ষ্য ছিল স্থির—ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশলে পড়বেন। ভালো ফলের সুবাদে ড্যাফোডিলে শতভাগ বৃত্তি পেয়ে যান। তাই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি।
সদ্য স্নাতক শিক্ষার্থীরা অনেক সময় খানিকটা দ্বিধায় ভোগেন। কী করব? কোথায় যাব? শাহেন শাহর মধ্যেও কি এমন সংশয় ছিল?
হোয়াটসঅ্যাপে আলাপকালে জানালেন, ‘একদমই না। আগে থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল—দেশের বাইরে যাব, পিএইচডি করব। গবেষণা করব। ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ছিলাম। আমাদের ব্যাচে আমার রেজাল্টই ছিল সবচেয়ে ভালো। তাই বুঝতে পারছিলাম, ঠিক পথেই আছি।’
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন শাহেন শাহ। এরই মধ্যে দুটি ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে চাকরির অভিজ্ঞতাও তাঁর হয়েছিল। ২০১৫ সালে তুরস্কের সরকারি বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে পাড়ি জমান ইস্তাম্বুলের ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
গবেষণা ও অর্জন
পিএইচডিতে চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে কাজ করেছেন শাহেন শাহ। বলছিলেন, ‘চালকবিহীন গাড়ির ক্ষেত্রে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো যোগাযোগের বিলম্বের শর্ত পূরণ করতে পারা ও সময়টা কমিয়ে নিয়ে আসা। এই বিলম্বটাই ১০০ মিলি সেকেন্ডে নামিয়ে আনতে পেরেছিলাম। এই আবিষ্কারের জন্য পরে স্বর্ণপদকও পেয়েছি।’
২০২১ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ইনভেনশন, ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি এক্সিবিশন (আইটেক্স)। সেখানেই পিএইচডি গবেষণার জন্য স্বর্ণপদক পান শাহেন শাহ। গবেষণার সাইটেশন সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের শীর্ষ ২ শতাংশ গবেষকের নাম প্রকাশ করা হয়। ২০২৩ সালে এই তালিকায় স্থান পান তিনি। বর্তমানে তিনি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইইইই) জ্যেষ্ঠ সদস্য।
নানা অর্জনের মধ্যে কোনটা আপনার চোখে সবচেয়ে বড়? জানতে চেয়েছিলাম। পুরস্কার বা স্বীকৃতির তুলনায় কাজটাকেই এগিয়ে রাখলেন শাহেন শাহ। বললেন, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য জরুরি যোগাযোগের যে পদ্ধতিটি তৈরি করতে পেরেছি, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন। আমি মনে করি, এটা অনেক মানুষের জীবন বাঁচাবে।’
বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের পরামর্শ একটাই, ‘যারা যে বিষয়ে কাজ করে মজা পায়, যার যে বিষয়ে আগ্রহ, সেটা নিয়েই পড়া উচিত। তাহলেই একজন শিক্ষার্থী তার সেরাটা দিতে পারবে।’