খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সংর্ঘষের ঘটনায়— শুরু হয় উত্তপ্ত পরিস্থিতি। তারই জের ধরে ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদের বিরোধী আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। তবে এবার সিন্ডিকেটের ওই সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সেই ছাত্রদলই। অন্যদিকে ভিসির বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে, ভিসির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কুয়েটের একাধিক শিক্ষকের সাথে কথা বলে তদন্তের ব্যাপারে জানা গেছে।
কুয়েট শিক্ষকরা জানিয়েছেন, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) শাব্বীর আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থীরা। এসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বহিষ্কারসহ রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবি জানিয়েছিলেন। ওই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে তেমন আগ্রহ না দেওয়া হলেও, গত সোমবার ৩৭ শিক্ষার্থীকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত, এবং গত বৃহস্পতিবার ২২ শিক্ষার্থীরা নামে মামলার ঘটনায়— ভিসির বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে এই তদন্তের দায়িত্বে কে কে রয়েছেন— সেই বিষয়টি নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চাননি।
শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে এই বিষয়টি ভিসি নিজেও জানেন। তাই এখন তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৩৭ শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ ঠেকানোর। সাথে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তিনি চেষ্টা চালাচ্ছেন।
যদিও বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য ফোন করা হলে ভিসির মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একটি অংশ ভিসির পক্ষে বুধবার বেলা পৌনে ১টায় প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে মিছিল করছেন। তারা পদত্যাগের এক দফা দাবির বিপক্ষে মৌন মিছিল, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন ও দাবি করেন, শিক্ষার্থীরা কুয়েট উপাচার্যকে হয়রানি করছে। পরে উপাচার্য পদত্যাগের এক দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরাও পাল্টা বিক্ষোভ মিছিল করেন।
এছড়া বুধবার রাতে ছাত্রদল দপ্তর সম্পাদক (সহ-সভাপতি পদমর্যাদা) মো. জাহাঙ্গীর আলম এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কুয়েটে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারাদেশ পুনর্বিবেচনার আহবান জানিয়েছেন।
তাতে বলা হয়েছে, তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে সিন্ডিকেট সভায় ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে আমরা সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এই বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটকে সহানুভূতির সাথে পুনর্বিবেচনা করার আহবান জানাচ্ছে। একইসাথে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে এনে দ্রুত শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করার আহবান জানাচ্ছে।
গত মঙ্গলবার দুপুর ২টা থেকে ছাত্রদের ছয়টি হলের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাতে কোনো বাধা দেয়নি। এর আগে তারা বিক্ষোভ মিছিল সহকারে প্রতিটি বিভাগের সামনে গিয়ে হ্যান্ডমাইকে হল খুলে দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানান। তবে প্রশাসনের কোন সাড়া না পেয়ে তাঁরা হলের তালা ভাঙ্গেন।
এর আগে গত রোববার দুপুর ৩টার দিকে শিক্ষার্থীরা এক জোট হয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। এসময় ফটকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য উপস্থিত থাকলেও— তাদের কেউ বাঁধা দেয়নি। যদিও বিজ্ঞপ্তি জারি করে নিষেধাজ্ঞা, অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ও সন্তান না পাঠাতে অভিভাবকদের ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছিল কুয়েট প্রশাসন। ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর থেকে শিক্ষার্থীরা হল খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তবে প্রশানের সাড়া না পেয়ে খোলা আকাশের নিচে তারা অবস্থান করেছেন।
এরপরে সোমবার বিকেলে কুয়েটের ১০১তম (জরুরী) সিন্ডিকেট সভায় ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
কুয়েটের জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগের পাবলিক রিলেশনস অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শাহেদুজ্জামান শেখ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, গত ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ৯৮ তম (জরুরী) সিন্ডিকেট সভায় গঠিত তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের দেওয়া প্রতিবেদন সিলগালা অবস্থায় সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করা হয় এবং তদন্ত প্রতিবেদনটি সিন্ডিকেট কতৃক গ্রহণ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষা কার্যক্রম আগামী ৪ মে শুরু হবে এবং আবাসিক হলগুলো আগামী ২ মে থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
একই সাথে গত বৃহস্পতিবার কুয়েটের ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আমলি আদালতে মামলা করেছেন নগরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার হোচেন আলী নামের এক ব্যক্তি। আদালত বাদীর অভিযোগ আমলে নিয়ে খানজাহান আলী থানাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন।
মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে হোচেন আলী কুয়েট রোড দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন। পকেট গেটের সামনে গেলে আসামিরা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে রড ও লাঠি দিয়ে মারধর করে এবং সোনার চেইন ছিনিয়ে নেন।
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কুয়েট প্রশাসন বাইরের একজনকে উসকানি দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছে।
শিক্ষার্থীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তা ছাড়া ২২ জনের নাম ও পরিচয় এভাবে বাইরের কোন ব্যক্তির পক্ষে জানা সম্ভব না।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। পরদিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায়, কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে কমিটিও করা হয়েছে। ওই দিন রাতেই খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে প্রশাসন।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনকে লাল কার্ড দেখান শিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে তাঁরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা খুলনা থেকে ঢাকায় এসে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেন। এতে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার, উপাচার্যের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি জানানো হয়।
এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের ৯৯তম (জরুরি) সভায় সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
খবর: টিবিএস