রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধের সময় ২ বছর বাড়িয়েছে রাশিয়া

 

chardike-ad

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ব্যবহৃত ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণের বিলম্বিত কিস্তির কারণে বাংলাদেশকে ১৬৪ মিলিয়ন ডলার জরিমানা থেকে অব্যাহতি দিতে রাশিয়া সম্মত হয়েছে।

এছাড়াও, মস্কো ঢাকার অনুরোধে সাড়া দিয়ে মূল পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলারের রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় ঋণের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়েছে এবং পরিশোধ শুরুর সময় ১.৫ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্র জানিয়েছে, মস্কো থেকে পাঠানো সংশোধিত প্রোটোকলের একটি খসড়া অনুযায়ী এখন মার্কিন ডলারের পাশাপাশি রাশিয়ান রুবলেও ঋণ পরিশোধ করা যাবে।

পূর্বে, ঋণ পরিশোধ এক মাস বিলম্বিত হলে বাংলাদেশকে ৪.৫ শতাংশ হারে জরিমানা দিতে হতো। ১৫ মার্চ ২০২২ থেকে ১৫ মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত সময়ে সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের ঋণের কিস্তি বকেয়া থাকলে বাংলাদেশকে প্রায় ১৬৪.১৭ মিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে হতো। তবে সংশোধিত প্রোটোকলে উল্লেখ করা হয়েছে, এই অর্থ ‘বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে না’, কারণ সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো প্রস্তাবিত চুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

ইআরডি কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, অর্থপ্রদানে বিলম্বের জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়, কারণ তহবিল সোনালী ব্যাংকে রোসাটমের অ্যাকাউন্টে জমা করা হলেও, ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়ান ব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে তা স্থানান্তর সম্ভব হয়নি।

রাশিয়ার সঙ্গে দুটি চুক্তির প্রস্তাবিত সংশোধনের বিষয়ে ইআরডি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছ থেকে মতামত চেয়েছে। এসব চুক্তির মধ্যে রয়েছে ২০১৩ সালের ৫০০ মিলিয়ন ডলারের সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন ঋণ এবং ২০১৬ সালের ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলারের মূল প্রকল্প ঋণ।

২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল বাংলাদেশ ও রাশিয়া প্রতিটি চুক্তির আওতায় একটি করে প্রোটোকলে স্বাক্ষর করেছে। দুই দেশ এখন এসব প্রোটোকলের বিভিন্ন ধারা সংশোধন করে দুটি নতুন প্রোটোকল স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ী, রাশিয়ার ব্যাংক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফরেইন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স-এর মাধ্যমে মার্কিন ডলার বা পারস্পরিক সম্মত যেকোনো মুদ্রায় ঋণ পরিশোধ করতে হতো। পরে বিকল্প মুদ্রা হিসেবে চীনা ইউয়ান যুক্ত করা হয়। এখন প্রস্তাবিত খসড়া প্রোটোকল অনুযায়ী, রাশিয়ান রুবল বা অন্য যেকোনো সম্মত মুদ্রায় যেকোনো নির্ধারিত ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য বকেয়া নিষ্পত্তিতে অধিক নমনীয়তা সৃষ্টি করবে।

ঋণ বিতরণ ও প্রকল্পে বিলম্ব

রূপপুর প্রকল্পের মোট আনুমানিক ব্যয় ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ—অর্থাৎ ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার—জোগান দিচ্ছে রাশিয়া এবং বাকি ১০ শতাংশ বহন করছে বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রায় ৭.৭০ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে, তবে কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থ বিতরণে বিলম্ব হয়েছে। খসড়া প্রোটোকলে স্বাক্ষর হলে অবশিষ্ট ৩.৬৮ বিলিয়ন ডলার ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি ও পরিশোধের সময়সূচি

রাশিয়ার পাঠানো খসড়া প্রোটোকল অনুযায়ী, মূলত ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত ঋণের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হবে, কারণ বাংলাদেশ সময়মতো প্রকল্পটি শেষ করতে পারেনি। ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ আন্তঃসরকারি ঋণ চুক্তি সংশোধনে সম্মতি দেন। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, উভয় পক্ষ শিগগিরই সংশোধনী চূড়ান্ত করবে বলে সম্মত হয়েছে।

প্রথমে বাংলাদেশের ২০২৭ সালের মার্চ থেকে ঋণের মূল অর্থ ও সুদ পরিশোধ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু সরকার ২০২৯ সালের মার্চ পর্যন্ত এই সময়সীমা পিছিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। সংশোধিত প্রোটোকলে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৮ তারিখকে ঋণ পরিশোধ শুরুর নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে ২০ বছরের মধ্যে বছরে দুইবার সমান কিস্তিতে অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

খসড়া প্রোটোকলে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে ২০ বছরের মধ্যে ৪০টি সমান কিস্তিতে—প্রতি বছর ১৫ মার্চ ও ১৫ সেপ্টেম্বর—ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে অব্যবহৃত ঋণের পরিমাণের ওপর ০.৫ শতাংশ হারে কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে, যার সর্বোচ্চ সীমা বার্ষিক ০.২৫ মিলিয়ন ডলার এবং তা পরবর্তী বছরের প্রথম প্রান্তিকে পরিশোধ করতে হবে।

বকেয়া পরিশোধ নিয়ে সংশোধিত শর্তাবলিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো কিস্তি ৩০ দিনের বেশি সময় ধরে বকেয়া থাকে, তবে তা বিলম্বিত হিসাবে বিবেচিত হবে এবং দৈনিক সুদের হার বার্ষিক ১৫০ শতাংশ হারে ধার্য হবে।

এছাড়া, ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তবে ১৫ মার্চ ২০২২ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালের মধ্যে জমা হওয়া প্রায় ৩.৬৩ বিলিয়ন ডলারের বকেয়াও বিলম্বিত ঋণ হিসেবে গণ্য হবে।