হুথিদের বিরুদ্ধে মার্কিন অভিযানে ব্যয় বিলিয়ন ডলার ফল আসেনি

 

chardike-ad

ইরান সমর্থিত হুথি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো সামরিক অভিযানে মাত্র তিন সপ্তাহেই ব্যয় পৌঁছেছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এ বিপুল পরিমাণ ব্যয় সত্ত্বেও হুথি গোষ্ঠীর সামরিক সক্ষমতায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো ধ্বংস বা ক্ষতি হয়নি বলে সিএনএনকে জানিয়েছে তিনটি সূত্র।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সামরিক অভিযান ১৫ মার্চ শুরু হয়। এর মধ্যে মার্কিন বাহিনী হুথিদের লক্ষ্য করে ব্যয় বহুল অস্ত্র ব্যবহার করে বিমান হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র জেএএসএসএম, জিপিএস-নির্ভর স্মার্ট বোমা জেএসওডব্লিউ, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র।

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা এ সপ্তাহে জানিয়েছেন, হুথিদের বিরুদ্ধে হামলায় ডিয়েগো গার্সিয়া থেকে মোতায়েন করা বি-২ স্টেলথ বোমার ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি, একটি অতিরিক্ত বিমানবাহী রণতরি, কয়েকটি যুদ্ধবিমান স্কোয়াড্রন এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সেন্ট্রাল কমান্ড অঞ্চলে শিগগিরই স্থানান্তর করা হবে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, এই সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে পেন্টাগনের কংগ্রেসের কাছে অতিরিক্ত বাজেট চাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে, তবে তারা সেটি পাবে কি না, তা অনিশ্চিত। কারণ, এই অভিযান ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে উভয় দলের পক্ষ থেকেই সমালোচিত হয়েছে।

এমনকি সহ-রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স-ও এই অভিযানকে ‘একটি ভুল’ বলে উল্লেখ করেছেন। দ্য আটলান্টিক ম্যাগাজিনে গত সপ্তাহে প্রকাশিত একটি সিগন্যাল চ্যাটে তিনি এ মন্তব্য করেন।

প্রতিদিন মার্কিন সামরিক হামলাগুলো হুথিদের ওপর প্রকৃতপক্ষে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে সে সম্পর্কে এখনও কিছু জানায়নি পেন্টাগন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পেন্টাগনের জয়েন্ট স্টাফ, ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড, ইউএস ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড, প্রতিরক্ষা নীতিবিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারিয়েট এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা কংগ্রেসকে এ বিষয়ে অবহিত করেছেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই হামলায় হুথি নেতাদের কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের কিছু সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে।

তবে সূত্রগুলো জানিয়েছে, হুথি গোষ্ঠী এখনো তাদের বাংকারগুলো শক্তিশালী করতে এবং ভূগর্ভে অস্ত্র মজুত রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের সময়ও তারা এটি রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল।

একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, হুথিদের কাছে বর্তমানে ঠিক কতটুকু অস্ত্র মজুত রয়েছে, তা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করাও অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

অভিযান সম্পর্কে এক সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, কিছু লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা হুথিদের সক্ষমতায় বড় কোনো প্রভাব ফেলেনি। তারা এখনো লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা চালাচ্ছে এবং মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করছে।

তিনি আরও বলেন, “অন্যদিকে আমরা নিজেদের অনেক শক্তি খরচ করে ফেলছি। বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ, জ্বালানি ও সময় ব্যয় হচ্ছে।”

এ সামরিক অভিযানের তথ্য কংগ্রেসকে জানানোর বিষয়টি প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস।

এখন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড সিইএনটিসিওএম-এর প্রধান এরিক কুরিলারের আর প্রতিটি হামলার জন্য ঊর্ধ্বতন অনুমোদনের প্রয়োজন হচ্ছে না, ফলে হামলার গতি বা তীব্রতা আরও বেড়ে গেছে।

এই পরিবর্তনটি বাইডেন প্রশাসনের সময়কার নীতির বিপরীত। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সামরিক কমান্ডারদের বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। তাদের প্রতিটি হামলা বা অভিযানের জন্য হোয়াইট হাউসের অনুমোদন নিতে হতো না। বরং তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, যদি সেটি ‘কৌশলগত প্রভাব’ ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় মনে হতো।

তবে এখনো পরিষ্কার নয়, ট্রাম্প প্রশাসন ঠিক কতদিন এই অভিযান চালিয়ে যেতে চায়। সিইএনটিসিওএম এই অভিযানকে ‘২৪/৭’ (চব্বিশ ঘণ্টা, সাত দিন) চলমান অপারেশন হিসেবে বর্ণনা করেছে।

ট্রাম্প জানিয়েছেন, এই অভিযান ততদিন চলবে যতদিন না হুথিরা লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা বন্ধ করে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে লাগাতার বোমাবর্ষণের পরেও হুথিরা তাদের হামলা অব্যাহত রেখেছে। তারা এখনো লোহিত সাগরের ওপর ও আশপাশে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করছে।

এই সপ্তাহের শুরুতেই তারা একটি মার্কিন এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে। সূত্র জানিয়েছে, এই অভিযান শুরুর পর থেকে এটি দ্বিতীয় রিপার ড্রোন যা হুথিদের হাতে ধ্বংস হলো।

তবে আরেকজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, শেষ এক সপ্তাহে হুথিদের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক বোমাবর্ষণ অভিযান হুথিদের জন্য যোগাযোগ করা এবং সঠিকভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা কঠিন করে তুলেছে, কারণ তাদেরকে এখন ‘মাথা নিচে রাখ’ থাকতে বাধ্য করা হয়েছে।

অভিযানের সম্পর্কে জানা লোকজন মার্কিন হামলায় নিহত হুথি কর্মকর্তাদের সম্পর্কে কথা বলেছেন। তারা জানান, ওই কর্মকর্তারা মধ্যম স্তরের ছিলেন। তারা মূলত ‘মিডল ম্যানেজমেন্ট’ ছিলেন।

তবে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো, হুথি গোষ্ঠীর ড্রোন অপারেশনগুলোর দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তাকে গত মাসে একটি হামলায় হত্যা করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ মার্চে দ্য আটলান্টিকের প্রকাশিত সিগন্যাল চ্যাটে ওই হুথি নেতার কথা উল্লেখ করেন। ওয়াল্টজ ওই চ্যাটে বলেন, হুথি গোষ্ঠীর ‘শীর্ষ ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞ’ মারা গেছেন। ইয়েমেনে তার বান্ধবীর বাসায় প্রবেশের সময় মৃত্যু হয়। কারণ হামলায় ওই ভবন ধসে পড়ে।

চলমান অভিযান সম্পর্কে একাধিক সূত্র জানায়, তারা মনে করছে ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে মার্কিন সেনাবাহিনী হামলা চালানোর ক্ষেত্রে আরও ‘বিস্তৃত’ করছে। এর মানে হলো, বাইডেন প্রশাসনের তুলনায় মার্কিন সেনারা এখন কল্যাটারাল ড্যামেজ বা ক্ষতিসাধন নিয়ে কম চিন্তিত। সূত্রগুলো জানিয়েছে, হুথিরা দীর্ঘদিন ধরে বেশি জনবহুল এলাকাগুলো ব্যবহার করে তাদের কমান্ড এবং কন্ট্রোল সাইটগুলো গোপন রেখেছে।

তবে এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই ভবনটি একটি সাধারণ আবাসিক ভবন ছিল না। বরং এটি ছিল হুথি কর্মকর্তাদের একটি বৈঠকস্থল। তিনি আরও বলেন, মার্কিন সেনাবাহিনী সঠিক লক্ষ্যভেদী অস্ত্র ব্যবহার করছে এবং বেসামরিক হতাহতের ঝুঁকি কমানোর জন্য অন্যান্য পদক্ষেপও গ্রহণ করছে।

বৃহৎ পরিসরের এই অভিযান ইউএস ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড-এর কিছু কর্মকর্তাকে চিন্তিত করে তুলেছে। তারা সম্প্রতি সিইএনটিসিওএম-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, হুথিদের বিরুদ্ধে যেভাবে দূরপাল্লার অস্ত্র যেমন জেএএসএসএম ও টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ হলে ওই অস্ত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের সামরিক পরিকল্পনাকারীরা উদ্বিগ্ন। কারণ তারা মনে করছেন, সিইএনটিসিওএম-এর অভিযান মার্কিন বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং প্রস্তুতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে প্যাসিফিক অঞ্চলে।

যদিও এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা এই উদ্বেগকে ‘অতিরঞ্জিত’ বিষয় বলে আখ্যা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আমরা প্রতিটি হামলায় সঠিক লক্ষ্যভেদী অস্ত্র ব্যবহার করি। আমরা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে হুথিদের বিরুদ্ধে আমাদের মোতায়েনকৃত বাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করার অনুমতি বজায় রাখি। আমাদের কার্যকারিতা সর্বাধিক করার জন্য প্রয়োজন হলে, আমরা দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারে কোনো উদ্বেগ অনুভব করি না।”