এখন থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে সরকারের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করতে হলে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। এমনকি, বাংলাদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন বা সাব কন্ট্রাক্ট্রিং করতে হলেও বিডার নিবন্ধন নিতে হবে।
বাংলাদেশে এককভাবে বা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে বা করবে এমন প্রতিষ্ঠানের লেনদেন আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এজন্য গত বছরের ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ‘গাইডলাইনস ফর অপারেশনস অব বিজনেস ইন বাংলাদেশ বাই জয়েন্ট ভেঞ্চার্স/কন্সর্টিয়ামস/অ্যাসোসিয়েশন্স (জেভিসিএ) হ্যাভিং ফরেন পার্টনার্স’ নীতিমালা জারি করেছে। ফরেন এক্সচেঞ্জ ইনভেন্টমেন্ট ডিপার্টমেন্ট (এফিআইডি) এর জারি করা ওই নীতিমালার আলোকে সরকারি দপ্তরগুলো বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেন্ডারে অংশ নেওয়ার আগে বিডাতে নিবন্ধন নেওয়ার নির্দেশনা জারি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারি প্রকল্পে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান একক বা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই বিডাতে নিবন্ধন নেই। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের অনেকে বাংলাদেশে ওয়ার্ক পারমিট নিচ্ছেন না। ফলে তাদের লেনদেন কীভাবে হচ্ছে বা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো মূলধন কীভাবে আনছে তা ষ্পষ্ট নয়।
আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজ শেষ না করেই চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে এসব কোম্পানি ও তাদের কর্মীরা যে আয় করছেন, তা থেকে যথাযথ রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। আবার যারা কাজ শেষ করছেন, তাদের কাছ থেকে যথাযথভাবে ট্যাক্স আদায় করা যাচ্ছে না। এসব বিবেচনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এই নীতিমালা জারি করা হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
বিডা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এই নীতিমালা জারির পর মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প অফিস খোলার জন্য বিডাতে আবেদন করেছে।
দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে নিযুক্ত সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক উদ্যোগ
এ বিষয়ে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, “যে সকল বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করবে, যারা তাদের কর্মী নিয়ে আসবে এবং বাংলাদেশ থেকে মূলধন-মুনাফা ফেরত নেবে—সেইসব প্রতিষ্ঠানের জন্য এই উদ্যোগটি খুবই ইতিবাচক। কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও রাজস্ব আহরণে এটা করা জরুরি।”
“তবে স্বল্প মেয়াদে যেসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কাজ করতে আসে বা আসবে তাদের ক্ষেত্রে এই নীতি প্রয়োগ করা হলে সেটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। এতে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের কারিগরি জ্ঞান পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারে,” বলেন তিনি।
প্রধান খাত
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ, আইসিটি বিভাগের প্রকল্পে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বেশি। ভারত, চীন, জাপান, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শতাধিক ঠিকাদার অবকাঠামো খাতের প্রকল্পে কাজ করছে। এর বাইরে অন্যান্য খাতেও বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
জানা গেছে, গত ১২ মার্চ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এক সার্কুলারে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরন করে টেন্ডারে অংশ নেওয়ার নির্দেশনা জারি করেছে।
যদিও তার আগে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর চায়না হারজোন ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন লিমিটেড নামের একটি চীনা কোম্পানিকে বিডাতে নিবন্ধন ছাড়াই সিলেট জোনের হবিগঞ্জ রোড ডিভিশনের একটি প্রকল্পের টেন্ডারে চূড়ান্ত দরদাতা হিসেবে মনোনীত করেছে। এই চায়না কোম্পানি বাংলাদেশের ইউনিভার্সাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার (বিডি) লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে টেন্ডারে অংশ নিয়ে এই কাজ পেয়েছিল। পরে এই খাতের অন্যান্য ঠিকাদাররা অভিযোগ করলে টেন্ডারটি স্থগিত করে তাদেরকে বিডাতে নিবন্ধন নেওয়ার নির্দেশনা দেয় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিডা থেকে নিবন্ধন পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট (এফইআরএ), ১৯৪৭ অনুযায়ী–বাংলাদেশ ব্যাংকের এফিআইডি বিভাগে রিপোর্ট করতে হবে। বিদেশি পার্টনার ও বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বৈধ চুক্তি থাকতে হবে। পাশাপাশি জেভিসিএ-কে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিয়ম অনুযায়ী ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিন), বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিন) এবং ভ্যাট নিবন্ধন নিতে হবে এবং নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, যৌথ অংশীদারি প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। সমস্ত বিদেশি লেনদেন অথরাইজড ডিলার (এডি) ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করতে হবে। প্রয়োজন হলে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) নিয়ে অন্যান্য ব্যাংকে স্থানীয় মুদ্রার একাধিক অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে।
তবে কোনো অংশীদারের বাংলাদেশি শাখা অফিসের মাধ্যমে টাকা আনা যাবে না। যদি প্রকল্পের অর্থায়ন বিদেশি উৎস থেকে হয়, তাহলে সরকার অনুমোদিত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে, তবে সেটি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত হবে। জেভিসিএ-কে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (বিএফআরএস) অনুযায়ী স্বতন্ত্র অডিটেড ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট (ব্যালেন্স শিট, আয়ের বিবরণী, ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট) প্রস্তুত করতে হবে। সমস্ত আয়ের তথ্য হিসাবপত্রে থাকতে হবে এবং কোনো দায়বদ্ধতা আয়ের সঙ্গে অফসেট করা যাবে না।
ওই যৌথ কোম্পানি যদি স্থানীয় ঋণ গ্রহণ করে, তবে তা ‘গাইডলাইন্স ফর ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রাঞ্জেকশন-২০১৮’ এর নিয়ম মানতে হবে। বিদেশি অংশীদারের প্রধান কার্যালয় থেকে সুদবিহীন ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন নেওয়া যাবে, তবে তা এডি ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করতে হবে।
বিদেশি অংশীদারের জন্য মুনাফা পাঠানোর অনুমতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে নিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দিতে হবে। রয়্যালটি, টেকনিক্যাল ফি বা ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী। যদি এর বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য অর্থ পাঠাতে হয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে।
যৌথ মালিকানার কোম্পানি বাংলাদেশে মূলধন বিনিয়োগ হিসেবে মেশিনারি আমদানি করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র (বিল অব এন্ট্রি) সংরক্ষণ করতে হবে। প্রকল্পে বিদেশি নাগরিকদের কাজের অনুমতি (ওয়ার্ক পার্মিট) এডি ব্যাংক যাচাই করবে এবং তাদের বেতন-ভাতা আর্থিক বিবরণীতে উল্লেখ করতে হবে। ওই কোম্পানিকে শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ওয়ার্কার্স প্রোফিট পারটিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) নিশ্চিত করতে হবে।
মুনাফা বা মূলধন পাঠাতে এবং ঋণ পরিশোধে যেসব কাগজ পত্র দাখিল করতে হবে, তা হলো—অডিটেড ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট, লভ্যাংশ বিতরণের অনুমোদন, বিদেশি অংশীদারের মূলধন অবদানের প্রমাণ, আয়কর মূল্যায়ন আদেশ ও সর্বশেষ এক বছরের ব্যাংক স্টেটমেন্ট।
একইভাবে মূলধনের অবশিষ্ট তহবিল বা ঋণ ফেরতের জন্য অফিস বন্ধের অনুমতি, প্রকল্প সমাপ্তির সনদ, কর পরিশোধের প্রমাণপত্র, শেষ তিন বছরের অডিট রিপোর্ট, কর্মীদের চূড়ান্ত পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে তার নিশ্চয়তাপত্র, অফিস ভাড়া নিষ্পত্তির কাগজপত্র ও সর্বশেষ এক বছরের ব্যাংক স্টেটমেন্ট দাখিল করতে হবে।
খবর: টিবিএস