এপ্রিলজুড়ে কৃষকের ঘরে উঠবে চলতি মৌসুমের নতুন সয়াবিন। তবে তার আগেই বাজারে পুরাতন শুকনো সয়াবিনের দর ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় কৃষক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রসেসিং মিল ও ফিড মিল মালিকরা বাজারদরের তুলনায় প্রতিকেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা কম দামে সয়াবিন কিনছেন। তবুও বাজারে ক্রেতা মিলছে না। অনেক মিল মালিক সয়াবিন কিনলেও ব্যবসায়ীদের অর্থ পরিশোধ করছেন না। ফলে অনেকের বাসাবাড়ি ও গুদামে মজুত সয়াবিন নষ্ট হতে শুরু করেছে।
শনিবার (২২ মার্চ) কয়েকজন কৃষক ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। তাদের মতে, গত ১০ বছরের মধ্যে এই সময়ে সয়াবিনের এমন দরপতন দেখা যায়নি। এতে একদিকে কৃষকরা উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ীরাও লোকসানের মুখে পড়ছেন।
আসন্ন মৌসুমে সয়াবিন বাজারে আসার আগেই এমন পরিস্থিতি কৃষকদের মাঝে আরও হতাশা তৈরি করছে।
দামে ধস, লোকসানে ছোট ব্যবসায়ীরা
লক্ষ্মীপুরের মতিরহাট এলাকার বাসিন্দা মিলন ভান্ডারি (৩৫)। মৌসুমে সয়াবিন কিনে ৮-১০ মাস পরে বিক্রি করেন তিনি । ৮-১০ মাস পর প্রতি কেজিতে ৫-১০ টাকা ব্যবসা হয় তার। গত ১২-১৩ বছর যাবত তিনি এ ব্যবসায় করে আসছেন।
একই এলাকায় মিলন ভান্ডারির মতো ১০-১২ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন। মিলন ভান্ডারি জানান, গত মৌসুমে প্রতিকেজি সয়াবিন ৬০ টাকা এবং প্রতিটন ৬০ হাজার টাকা দরে ১০০ টন সয়াবিন কিনে নিজের আড়তে সংরক্ষণ করেছিলেন। প্রতি বছর নতুন সয়াবিন বাজারে ওঠার আগেই পুরাতন সয়াবিন বিক্রি করে দেন তারা।
কিন্ত এ বছর সয়াবিনের ক্রেতা নেই, বিক্রি কমে গেছে। মিল মালিকরা ক্রয় মূল্যের চেয়ে প্রতি কেজিতে ২০-২৫ টাকা কমে দাম বলছেন। এতে প্রতিটনে ২০-২৫ হাজার টাকা ক্রয় মূল্যই নেই। পাশাপাশি পুরো বছরের অন্যান্য খরচ এবং ব্যাংক ঋণ তো আছেই । সব মিলে বড় অংকের ক্ষতিতে পড়েছেন তারা।
কমলনগর উপজেলার সবচেয়ে বড় সয়াবিন ব্যবসায়ী কাশেম ট্রেডার্সের মালিক কাশেম মিয়া গণমাধ্যমকে জানান, তার আড়তে বর্তমানে প্রায় ১ হাজার টন সয়াবিন মজুত রয়েছে। প্রতি টনে তিনি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন, যার মোট পরিমাণ প্রায় ১ কোটি টাকা।
চর রমনী মোহন এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবদুল মালেক বলেন, “আমরা মূলত কৃষকদের কাছ থেকে স্থানীয়ভাবে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সয়াবিন কিনে থাকি। পরে মিল মালিকরা সারা বছর ধরে আমাদের কাছ থেকে সেটা সংগ্রহ করেন। কিন্তু এখন মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে আমাদের থেকে কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেকেই কম দামে কিনলেও আমাদের টাকা পরিশোধ করছেন না। এতে আমরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের এই ক্ষতির প্রভাব এবার মৌসুমের শুরুতেই কৃষকদের ওপর গিয়ে পড়বে। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং সয়াবিন উৎপাদনে অনীহা তৈরি হবে।”
লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর চরের কৃষক মো. কিরন, মো. আল আমিন ও মোক্তার হোসেন মুক্ত জানান, গত মৌসুমে তারা ক্ষেত থেকেই প্রতি কেজি ৬০ টাকা দরে সয়াবিন বিক্রি করেছেন। এখন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সেই সয়াবিন ৪০ টাকাতেও বিক্রি করতে পারছেন না। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ায় এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কৃষকদের ওপর।
সয়াবিন প্রসেস মিল মালিক মো. নোমান হোসেন জানান, “আমরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সয়াবিন কিনে প্রসেস করে তা ফিড কোম্পানির কাছে বিক্রি করি। এতে প্রতি কেজিতে তিন টাকা খরচ হয়। কিন্তু এ বছর ফিড কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে কম দামে সরাসরি প্রসেস করা সয়াবিন কিনছে। ফলে দেশীয় সয়াবিনের দাম ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।”
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে কৃষকরা বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন এবং অনেকে সয়াবিন চাষ থেকে সরে যেতে পারেন।”
সয়াবিন ব্যবসায়ী মো. ইসমাইল হোসেন জানান, বাংলাদেশে উৎপাদিত সয়াবিন মূলত ফিড শিল্পে ব্যবহৃত হয়। গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন দানার দাম কমে যাওয়ায় বড় বড় কোম্পানি বিদেশ থেকেই সয়াবিন আমদানি করছে। তবে এতে দেশের বাজারে পোল্ট্রি, ফিশ এবং ক্যাটল ফিডের দাম একটুকুও কমেনি।
তিনি বলেন, “সয়াবিনের দাম পড়ে গেলে কৃষকরা চাষে অনাগ্রহী হয়ে পড়বে। এ সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন বড় ব্যবসায়ীরা, তারা তখন বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পাবেন।”
প্রসেস মিল মালিক নোমান হোসেন, ব্যবসায়ী ছিদ্দিক, শরাফত, রিয়াজ, ইসমাইল এবং মিলন ভান্ডারী জানান, বর্তমানে শুধু লক্ষ্মীপুর জেলাতেই কৃষক ও ব্যবসায়ীদের হাতে বিক্রির জন্য অন্তত ১০ হাজার টন সয়াবিন মজুত রয়েছে।
এদিকে লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে জেলার ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ হয়েছে এবং প্রায় ৮৮ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কৃষি বর্ষগ্রন্থ ২০২৩ অনুযায়ী, দেশে যে কয়টি জেলায় সয়াবিন চাষ হয়, তার মধ্যে এককভাবে লক্ষ্মীপুরেই উৎপাদিত হয় দেশের মোট সয়াবিনের ৭৭ শতাংশ। জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে চারটি উপজেলায় ব্যাপক হারে সয়াবিন আবাদ হয়। সয়াবিন এখন লক্ষ্মীপুরের অন্যতম অর্থনৈতিক ফসল, যেখানে প্রায় এক লাখ কৃষক সরাসরি এ পণ্যের উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।
খবর: টিবিএস