বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোর দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে আগামী এপ্রিলে এক বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি বেশি হবে–এমন প্রতিষ্ঠানকে অগ্রধিকার দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।

chardike-ad

আয়োজকদের মতে, এই সম্মেলনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংস্কারের অগ্রগতি তুলে ধরা হবে, যাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যায়।

চার দিনব্যাপী এই সম্মেলনে পাঁচটি প্রধান খাতে বিনিয়োগের সুযোগ তুলে ধরা হবে—নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ডিজিটাল অর্থনীতি, টেক্সটাইল ও পোশাক, স্বাস্থ্যসেবা ও ফার্মাসিউটিক্যালস এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫’ আয়োজন করবে। এই সম্মেলন ৭-১০ এপ্রিল ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত হবে।

বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন গণমাধ্যম-কে বলেন, “আমরা এমন খাতগুলোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি, যেখানে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমি মনে করি, শুধু বিনিয়োগের ডলারের পরিমাণ না দেখে চাকরির সুযোগ তৈরির দিকেও নজর দেওয়া উচিত। কেউ যদি বলে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ১০০ জনকে চাকরি দেবে, আর অন্য কেউ ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ১,০০০ জনের কর্মসংস্থান করবে—তাহলে আমরা দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিকেই বেশি গুরুত্ব দেব। আমাদের দেশের জন্য আমরা এই দিকেই বেশি ফোকাস করার চেষ্টা করছি।”
আয়োজকদের মতে, আসন্ন সম্মেলনের জন্য ইতোমধ্যেই ৫০টি দেশের ২,৩০০-এর বেশি অংশগ্রহণকারী নিবন্ধন করেছেন, যার মধ্যে ৫৫০-এরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগকারী রয়েছেন।

শীর্ষ অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সিঙ্গাপুর ও জাপান। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল আসছে চীন থেকে।

আশিক মাহমুদ জানান, চীনা বিনিয়োগকারীরা বিশেষভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আগ্রহী, পাশাপাশি তারা টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে উৎপাদনমুখী শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনাও করছে।

৯ এপ্রিল ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করা হবে। এতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, ব্যবসায়ী নেতারা ও নীতিনির্ধারকরা উপস্থিত থাকবেন।

এছাড়া, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লাইভ ইন্টারনেট সেবা প্রদান করবে যুক্তরাষ্ট্রের টেলিকম জায়ান্ট স্টারলিংক, এদিন বাংলাদেশে তাদের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে।

রোববারের সংবাদ সম্মেলনে, বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, সম্মেলনের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বিনিয়োগের অন্যতম গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।

“বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। এই সম্মেলন কেবল বিনিয়োগের সুযোগ তুলে ধরবে না, বরং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য নেওয়া বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগগুলোও তুলে ধরবে,” যোগ করেন তিনি।

বৈশ্বিক ব্যবসায়ী নেতারা সম্মেলনে অংশ নেবেন

সম্মেলনে শীর্ষ অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সিঙ্গাপুর ও জাপান।

সম্মেলনটি বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে, যেখানে তারা বাংলাদেশের উন্নত অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো এবং খাতভিত্তিক সুযোগগুলো অন্বেষণ করতে পারবেন।

সম্মেলনে অংশ নেবেন বেশ কিছু উচ্চপদস্থ ব্যবসায়ী নেতা। তাদের মধ্যে রয়েছেন জারা গ্রুপের সিইও ওস্কার গার্সিয়া মাসেইরাস, ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম, যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য প্রতিনিধি রোজি উইন্টারটন, স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট কেয়ংসু লি, জিওর্ডানোর সিইও জুনসেক হান, এক্সিলারেট এনার্জির সিইও স্টিভেন কোবস, উবার এশিয়া-প্যাসিফিকের পাবলিক পলিসি প্রধান মাইক অর্গিল, এবং মেটার পাবলিক পলিসি পরিচালক সারিম আজিজ।

চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, “বিদেশে বসে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ বেশি পাচ্ছে তারা। তাই আমরা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সরাসরি বাংলাদেশে আনছি, যাতে তারা এখানে এসে বাংলাদেশের শক্তি সম্পর্কে নিজে দেখে যেতে পারে এবং পরে তা পৃথিবীজুড়ে জানাতে পারে।”

তিনি বলেন, “সম্মেলনে যারা অংশ নেবেন, তাদের মাধ্যমে একটি বিনিয়োগ পাইপলাইন তৈরি হবে, এবং আমরা বিডা থেকে সেটি সিরিয়াসলি ট্র্যাক করব। এর ভিত্তিতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কাজ করব।”

আশিক মাহমুদ আরও বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগ গত জুলাই-আগস্টের আগেই কিছুটা নিম্নগামী ছিল। আমাদের এফডিআই (বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ) জিডিপির তুলনায় খুবই ছোট, ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে। আমাদের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী এটি আরও ১০ গুণ বেশি হওয়া উচিত ছিল। তবে আশা করি, এবছর গতবছরের তুলনায় কিছুটা বেশি বিনিয়োগ হবে।”

“তবে এটা রাতারাতি বাড়বে না, কারণ বিনিয়োগকারীরা রাতারাতি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন না। বিনিয়োগ উন্নয়নে আমরা বেশ কিছু সংস্কার গ্রহণ করেছি, এবং আশা করি আগামীতে এফডিআই প্রতি অর্থবছরে দুই থেকে তিন গুণ বাড়বে,” যোগ করেন তিনি।

আয়োজনে যা থাকছে

সম্মেলনের অংশ হিসেবে, ৭ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার ২৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে সফর করবে, যার মধ্যে চট্টগ্রাম, মিরসরাই এবং কোরিয়ান ইপিজেড অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই সফরের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সরাসরি দেখতে পারবেন।

এছাড়া, একই দিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি স্টার্টআপ-ভিত্তিক ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হবে।

৮ এপ্রিল আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা নারায়ণগঞ্জের অড়াইহাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বিএসইজেড) পরিদর্শন করবেন, পরে সন্ধ্যায় একটি নেটওয়ার্কিং সেশন অনুষ্ঠিত হবে।

মূল আয়োজনের উদ্বোধন হবে ৯ এপ্রিল।

১০ এপ্রিল, একাধিক সেশনে ডিজিটাল অর্থনীতি, টেক্সটাইল, কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ এবং স্বাস্থ্যখাতের মতো প্রধান বিনিয়োগ খাতগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। এদিন একটি ম্যাচমেকিং সেশন এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগের সেরা উদাহরণগুলো নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

সম্মেলনে বিনিয়োগকারীদের আলোচনার জন্য নির্ধারিত মিটিং রুম থাকবে—যার মধ্যে বোর্ডরুম, লাউঞ্জ এবং মধুমতী ও তুরাগ কনফারেন্স হলের মতো ডেলিগেশন রুম থাকবে। এছাড়া, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দ্বিতীয় তলায় নেটওয়ার্কিং স্পেসও থাকবে।

আশিক মাহমুদ বলেন, “সামিটের প্রধান উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের বর্তমান সঠিক অবস্থাটা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরা। বাংলাদেশ একটি ট্রানজিশন ফেজের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, এবং এই ট্রানজিশন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”

তিনি বলেন, “দেশ এখন অনেক ভালো অবস্থায় রয়েছে, যা বিদেশে বসে সহজে বোঝা যায় না। আমাদের মাক্রো ইকোনমি স্থিতিশীল, ফরেন রিজার্ভ স্থিতিশীল, ফরেন কারেন্সি এক্সচেঞ্জ রেটও স্থিতিশীল, এবং জুলাই-আগস্টের সংকটের পরও আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। অর্থনীতি সঠিক পথে এগিয়ে চলছে, এবং আমরা এই বিষয়গুলো সামিটে তুলে ধরব।”

“তবে, আমাদের যে কোনো সমস্যা নেই—এটিও বলা যাবে না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে কিছুটা সমস্যা এখনও রয়েছে, তবে আমরা তা দূর করার চেষ্টা করছি,” যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) আগামী সম্মেলনে স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সহযোগিতা করবে। তিনি আরও জানান, সম্মেলনের সময় ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসব রাজনৈতিক দলের জন্য আলাদা রুম বরাদ্দ করা হবে।

আশিক মাহমুদ জানান, বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করার জন্য অন্তবর্তী সরকার যেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারও তা অব্যাহত রাখবে এবং এই আশ্বাসটি সম্মেলনে বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছানো হবে।

সম্মেলন উপলক্ষে বিভিন্ন মন্ত্রাণালয় এবং সংস্থা যেমন—জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), এবং অন্যান্য বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রাণালয় এবং প্রতিষ্ঠানগুলোও নির্দিষ্ট রুম বরাদ্দ পেয়েছে।

ইভেন্টের মূল অংশীদারদের মধ্যে রয়েছে ইউএনডিপি, এফসিডিও, গ্রামীণফোন, বিশ্বব্যাংক এবং এফআইসিসিআই।