যাত্রাবাড়ীতে প্রকাশ্যে তরুণকে কুপিয়ে হত্যার নেপথ্য কি?

 

chardike-ad

 

 

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দনিয়া কলেজের সামনের সড়কে গত মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রকাশে কুপিয়ে হত্যা করা হয় প্রকৌশলী মিনহাজুল রহমানকে (২৫)। স্থানীয়রা বলছেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হতে না পারলেও পুলিশ বলছে, আধিপত্যের কারণে এই হত্যাকাণ্ড হতে পারে। তবে তদন্ত শেষ হলে এটি নিশ্চিত হওয়া যাবে।

পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর বুধবার (২৯ জানুয়ারি) রাত ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সোনারামপুর পারিবারিক কবরস্থানে মিনহাজুলকে দাফন করা হয়। এর আগে বিকাল ৫টার দিকে দনিয়া কলেজ প্রাঙ্গণে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।

মিনহাজুল হত্যাকাণ্ডের পর তার সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন যাত্রাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. রফিকুল ইসলাম। প্রতিবেদনে এসআই উল্লেখ করেন, দনিয়া কলেজের সামনে অজ্ঞাতনামা লোকজন বিভিন্ন ধরনের ধারালো অস্ত্র দ্বারা গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মাথায়, বুকে-পিঠে এবং হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২৭টি কোপের চিহ্ন রয়েছে।

এঘটনায় বুধবার দুপুরে নিহতের বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন বাদি হয়ে ‘কিং মাহফুজ’সহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১৯ জনকে আসামি করে যাত্রবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মিনহাজুল দনিয়া কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী। গত ২৬ জানুয়ারি ধনিয়া কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আরহান সরকার মাহফুজ ওরফে কিং মাহফুজসহ (২৬) অন্য আসামিদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক ও বিরোধের সৃষ্টি হয়। পরে ২৮ জানুয়ারি বিকালে মিনহাজ ও তার বন্ধু আহাদকে নিয়ে দনিয়া কলেজের সামনে যায়। সেখানে কিং মাহফুজসহ অন্য আসামিরা পরিকল্পিতভাবে সুইচ গিয়ার, চাকু, চাপাতি, রাম দাসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মিনহাজুলকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তাক্ত গুরুতর জখম করে। এতে তিনি মারা যান।

জানা যায়, নিহত মিনহাজুল দনিয়া কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি নারায়গঞ্জের পার্ক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ তার বাবা হাফেজ কারী মো. রফিকুল ইসলাম ওলামা দলের নেতা। তিনি ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। দনিয়া কলেজ এবং স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারে মিনহাজুলের কর্মী সমর্থকও রয়েছে। দনিয়ে কলেজের আধিপত্য নিয়ে স্থানীয় আরেক গ্যাং লিডার কিং মাহফুজের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল। গত কয়েক মাসে তাদের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল।

অন্যদিকে মিনহাজুল হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত আরহান সরকার মাহফুজ ওরফে কিং মাহফুজের বাবা সিদ্দক মিয়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাহফুজ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। ৫ আগস্টের পর ছাত্রলীগের রাজনীতি ছেড়ে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দাবি করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে মাহফুজের একটি গ্যাং কালচার তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর থেকে মিনহাজুলের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হয়। মিনহাজুল হত্যাকাণ্ডের আগে একাধিকবার তাদের মঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নিহত মিনহাজুল ও মূল অভিযুক্ত কিং মাহফুজ দুইজনেরই স্থানীয়ভাবে গ্যাং রয়েছে। তারা এলাকার আধিপত্য বিস্তার করতে বিভিন্ন ভাবে লোকবল নিয়ন্ত্রণ করে এবং এলাকায় একটি তাসের আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করছে। তাদের দুইজনের পূর্বের সরকারি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং ছাত্রদল হিসাবে দাবি করে আসছিল প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছিল। এসব ঘটনায় নিয়ে মিনহাজুল ও কিং মাহফুজের গ্যাং সদস্যদের সঙ্গে একাধিকবার সংঘর্ষ ও মারধরের ঘটনা ঘটেছিল।

মিনহাজুল হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার এসআই গিয়াস উদ্দিন বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। মামলার এজাহারে উল্লেখ্য করেছে, দনিয়া কলেজের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষ। এটি আসলে তদন্ত না করে বলা যাবে না। তবে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি দনিয়া কলেজ ও স্থানীয় আধিপত্যকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে।

নিহত মিনহাজুলের ভগ্নিপতি মো. খালিদ মাহফুজ গণমাধ্যমকে বলেন, মিনহাজুল দনিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে। তিনি কলেজে এবং স্থানীয়ভাবে বেশ জনপ্রিয় ছিল। স্থানীয় চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও গ্যাং লিডার কিং মাহফুজের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল। কিছুদিন আগে কলেজের একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মিনহাজ ও কিং মাহফুজের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে মাহফুজ তাকে হত্যা করতে কয়েক রাউন্ড গুলিও ছুড়েছিল। এছাড়াও মাহফুজ গ্যাং কলেজের সবুব নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে। সেই ঘটনায় মিনহাজুল সবুজকে রক্ষা করেছিল। এসব বিষয় নিয়ে মিনহাজুলকে একাধিকবার হত্যা করার চেষ্টা করেছিল কিং মাহফুজ ও তার গ্যাংয়ের সদস্যরা।

মিনহাজুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের সোনারামপুরে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। গত বছরের তার বিবাহ হয়েছে। তার স্ত্রী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি নারায়গঞ্জের পার্ক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিলেন।

ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডেমরা জোন) এম এম সবুজ রানা গণমাধ্যমকে বলেন, মিনহাজুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে অধিকতর তদন্ত চলছে। তবে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, স্থানীয় আধিপত্যকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হতে পারে। তবে বিষয়টি এখনই বলা বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।

 

খবর: বাংলা ট্রিবিউন